পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ধর্মীরাজের স্থান জুড়িয়া বসিতে চাও ! তাই করিয়া আজ শত শত বৎসর ধরিয়া এতবড়ো একটি সমগ্ৰ জাতিকে তুমি মর্মে মর্মে শৃঙ্খলিত করিয়া তাহাকে পরাধীনতার অন্ধকূপের মধ্যে পঙ্গু করিয়া ফেলিয়া দিয়াছ- তাহার। আর উদ্ধারের পথ রাখ নাই। যাহা ক্ষুদ্র, যাহা স্কুল, যাহা অসত্য, যাহা অবিশ্বাস্য তাঁহাকেও দেশকালপত্র অনুসারে ধর্মবলিয়া স্বীকার করিয়া কী প্রকাণ্ড, কী অসংগীত, কী অসংলগ্ন জঞ্জালের ভয়ংকর বোঝা মানুষের মাথার উপরে আজ শত শত বৎসর ধরিয়া চাপাইয়া রাখিয়াছ! সেই ভগ্নমেরুদণ্ড নিষ্পেষিতপৌরুষ নতমস্তক মানুষ প্রশ্ন করিতেও জানে না, প্রশ্ন করলেও তাহার উত্তর কোথাও নাইকেবল বিভীষিকার তাড়নায় এবং কাল্পনিক প্রলোভনের ব্যৰ্থ আশ্বাসে তাঁহাকে চালনা করিয়া যাইতেছে ; চারি দিক হইতেই আকাশে তর্জনী উঠিতেছে এবং এই আদেশ নানা পরুষকণ্ঠে ধ্বনিত হইতেছে, যাহা বলিতেছি তাহাই মানিয়া যাও, কেননা তুমি মূঢ় তুমি বুঝিবে না; যাহা পীচজনে করিতেছে তাহাই করিয়া যাও, কেননা তুমি অক্ষম ; সহস্ৰ বৎসরের পূর্ববর্তীকালের সহিত তোমাকে আপাদমস্তক শতসহস্ৰ সূত্রে একেবারে বঁধিয়া রাখিয়াছি, কেননা নূতন করিয়া নিজের কল্যাশচিন্তা করিবার শক্তিমাত্র তোমার নাই। নিষেধজর্জরিত চিরকাপুরুষ নির্মাণ করিবার এত বড়ো সর্বদেশব্যাপী ভয়ংকর লীেহযন্ত্র ইতিহাসে আর কোথাও কি কেহ সৃষ্টি করিয়াছে- এবং সেই মনুষ্যত্ব চূৰ্ণ করিবার যন্ত্রকে আর কোনো দেশে কি ধর্মের পবিত্র উপাধিতে আখ্যাত করা হইয়াছে ? দুৰ্গতি তো প্রত্যক্ষ, আর তো কোনো যুক্তির প্রয়োজন দেখি না, কিন্তু সেই প্রত্যক্ষকে চােখ মেলিয়া দেখিব না, চোখ বুজিয়া কি কেবল তৰ্কই করিব ? আমাদের দেশে ব্রহ্মের ধ্যানে পূজাৰ্চনায় যে বহুবিচিত্র স্থূলতার প্রচার হইয়াছে তর্ককালে তাহাকে আমরা চরম বলিয়া মানি না। আমরা বলিয়া থাকি, যে মানুষ আধ্যাত্মিকতার যে অবস্থায় আছে। এ দেশে তাহার জন্য সেইপ্রকার আশ্রয় গড়িয়া দেওয়া হইয়াছে; এইরূপে প্ৰত্যেকে নিজ নিজ আশ্রয়ে থাকিয়া ক্রমশ স্বতই উচ্চতর অবস্থার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। কিন্তু জানিতে চাই অনন্ত কালের অসংখ্য মানুষের প্রত্যেক ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার জন্য সেরূপ উপযুক্ত আশ্রয় গড়িতে পারে এমন সাধ্য কাহার । সমস্ত বিচিত্রতাকেই স্থান দিবে, বাধা দিবে না, এতবড়ো বিশ্বকর্ম মানবসমাজে কে আছে ? ? বস্তুত মানুষের অসীম বৈচিত্র্যকে যাহারা সত্যই মানে তাহারা মানুষের জন্য অসীম স্থানকেই ছাড়িয়া রাখে। ক্ষেত্র যেখানে মুক্ত, বৈচিত্র্য সেখানে আপনি অবাধে আপনাকে প্রকাশ করিতে পারে। এইজনাই যে-সমাজে জাগ্রত ও নিদ্রিত কালের সমস্ত ব্যাপারই একেবারে পাকা করিয়া বাধা সেখানে মানুষের চরিত্র আপন স্বাতন্ত্র্যে দৃঢ় হইয়া উঠিতে পারে না, সকলেই একস্থাচে গড়া নিজীব ভালোমানুষটি হইয়া থাকে। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও সে কথা খাটে। মানুষের সমস্ত চিন্তাকে কল্পনাকে পর্যন্ত যদি অবিচলিত স্কুল আকারে একেবারে বাধিয়া ফেলা যায়, যদি তাঁহাকে বলা যায় অসীমকে তুমি কেবল এই একটিমাত্র বা কয়টিমাত্র বিশেষ রূপেই চিন্তা করিতে থােক, তবে সেই উপায়ে সত্যই কি মানুষের স্বাভাবিক বৈচিত্র্যকে আশ্রয় দেওয়া হয়, তাহার চিরধাবমান পরিণতিপ্রবাহকে সাহায্য করা হয় ? ইহাতে তাহার আধ্যাত্মিক বিকাশকে কি বন্ধ করাই হয় না, আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তাহাকে কৃত্রিম উপায়ে মূঢ় ও পঙ্গু করিয়াই রাখা হয় না ? এই যে এক সুবিশাল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে নানাজাতির নানালোক শিশুকাল হইতে বাৰ্ধক্য পর্যন্ত নানা অবস্থার মধ্য দিয়া চিন্তা করিতেছে, কল্পনা করিতেছে, কর্মকরিতেছে ইহারা যদি একই জগতের মধ্যে সকলে ছাড়া না গাইত, যদি একদল প্রবলপ্রতাপশালী বুদ্ধিমান ব্যক্তি মন্ত্রণা করিয়া বলিত ইহাদের প্রত্যেকের জন্য এবং প্ৰত্যেকের প্রত্যেক ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার জন্য স্বতন্ত্রকারিয়া ছোটাে ছোটো জগৎ একেবারে পাকা করিয়া বাধিয়া দেওয়া যাইবে তবে কি সেই হতভাগ্যদের উপকার করা হইত ? মানবচিত্তের চিরবিচিত্র অভিব্যক্তিকে কোনো কোনো কৃত্রিম সৃষ্টির মধ্যে চিরদিনের মতো আটক করা যাইতে পারে এ কথা যিনি কল্পনাও করিতে পারেন তিনি বিশ্বের অমিত্র। ছোটাে হইতে বড়ো, অবোধ হইতে সুবোধ পর্যন্ত সকলেই এই একই অসীম জগতে বাস করিতেছে বলিয়াই প্রত্যেকেই আপনি বুদ্ধি ও প্রকৃতি অনুসারে ইহার মধ্য হইতে আপন শক্তির পরিমাণ পুরা প্রাপ্য আদায় করিয়া লইবার চেষ্টা করিতেছে। সেইজন্যই শিশু যখন কিশোর বয়সে না। তাহার বুদ্ধি বাড়িল, শক্তি বাড়িল, জািন বাড়িল তৰুতাহাকে নূতন জগতের সন্ধানে দুটাছুটি করিয়া