পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ዓዪኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী দুই টানার তাল বীচাইয়া সমে আসিয়া পেঁৗছতে শেখাই মনুষ্যত্বের শিক্ষা; এই তাল-অভ্যাসের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস। ভারতবর্ষে সেই তালের সাধনার ছবিটিকে স্পষ্ট করিয়া দেখিবার সুযোগ আছে। গ্ৰীস রোম ব্যাবিলন প্রভৃতি সমস্ত পুরাতন মহাসভ্যতার গােড়াতেই একটা জাতিসংঘাত আছে। এই জাতিসংঘাতের বেগেই মানুষ পরের ভিতর দিয়া আপনার ভিতরে পুরামাত্রায় জাগিয়া উঠে। এইরূপ সংঘাতেই মানুষ রঢ়িক হইতে যৌগিক বিকাশ লাভ করে এবং তাহাকেই বলে সভ্যতা। পর্দা উঠিবামাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথমাঙ্কেই আমরা আর্য-অনার্যের প্রচণ্ড জাতিসংঘাত দেখিতে পাই | এই সংঘাতের প্রথম প্রবলবেগে অনার্যের প্রতি আর্যের যে বিদ্বেষ জাগিয়াছিল তাঁহারই ধাক্কায় আর্যেরা নিজের মধ্যে নিজে সংহত হইতে পারিল। এইরূপ সংহত হইবার অপেক্ষা ছিল। কারণ, ভারতবর্ষে আর্যেরা কালে কালে ও দলে দলে প্রবেশ করিতেছিলেন। তঁহাদের সকলেরই গোত্র, দেবতা ও মন্ত্র যে একই ছিল তাহা নহে। বাহির হইতে যদি একটা প্রবল আঘাত তাহাদিগকে বাধা না দিত। তবে এই আর্য উপনিবেশ দেখিতে দেখিতে নানা শাখা-প্রতিশাখায় সম্পূর্ণ বিভক্ত হইয়া বিক্ষিপ্ত হইয়া যাইত। তাহারা আপনাদিগকে এক বলিয়া জানিতে পারিত না। আপনাদের সামান্য বাহ্য ভেদগুলিকেই বড়ো করিয়া দেখিত। পরের সঙ্গে লড়াই করিতে গিয়াই আর্যেরা আপনাকে আপনি বলিয়া উপলব্ধি করিলেন । । বিশ্বের সকল পদার্থের মতো সংঘাত পদার্থেরও দুই প্রান্ত আছে- তাহার এক প্রান্তে বিচ্ছেদ, আর-এক প্রান্তে মিলন। তাই এই সংঘাতের প্রথম অবস্থায় স্ববর্ণের ভেদরক্ষার দিকে আর্যদের যে আত্মসংকোচন জন্মিয়ছিল। সেইখনেই ইতিহাস চিরকাল থামিয়া থাকিতে পারে না। বিশ্বছন্দ-তত্ত্বের নিয়মে আত্মপ্রসারণের পথে মিলনের দিকে ইতিহাসকে একদিন ফিরিতে হইয়াছিল। অনার্যদের সহিত বিরোধের দিনে আৰ্যসমাজে যাহারা বীর ছিলেন, জানি না তঁহারা কে। তঁহাদের চরিত্যকাহিনী ভারতবর্ষের মহাকাব্যে কইতেমন করিয়া তো বর্ণিত হয় নাই। হয়তো জনমেজয়ের সর্পসত্রের কথার মধ্যে একটা প্রচণ্ড প্রাচীন যুদ্ধ ইতিহাস প্রচ্ছন্ন আছে। পুরুষানুক্রমিক শক্রতার প্রতিহিংসা-সাধনের জন্য সৰ্প-উপাসক অনার্য নাগজাতিকে একেবারে ধ্বংস করিবার জন্য জনমেজয় নিদারুণ উদযোগ করিয়াছিলেন এই পুরাণ-কথায় তাহা ব্যক্ত হইয়াছে বটে। তবু এই রাজা ইতিহাসে তো কোনো বিশেষ গীেরব ब्लाङ दाद्रन्म नरैि । কিন্তু অনাৰ্যদের সহিত আৰ্যদের মিলন ঘটাইবার অধ্যবসায়ে যিনি সফলতা লাভ করিয়াছিলেন তিনি আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে অবতার বলিয়া পূজা পাইয়া আসিতেছেন। ; আৰ্য-অনার্যের যোগবন্ধন তখনকার কালের যে একটি মহা উদযোগের অঙ্গ, রামায়ণ-কাহিনীতে সেই উদযোগের নেতারূপে আমরা তিনজন ক্ষত্রিয়ের নাম দেখিতে পাই। জনক, বিশ্বামিত্র ও রামচন্দ্র। এই তিনজনের মধ্যে কেবলমাত্র একটা ব্যক্তিগত যোগ নহে একটা এক-অভিপ্ৰায়ের যোগ দেখা যায়। বুঝিতে পারি, রামচন্দ্রের জীবনের কাজে বিশ্বামিত্র দীক্ষাদাতা— এবং বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের সম্মুখে যে লক্ষ্যস্থাপন করিয়াছিলেন তাহা তিনি জনক রাজার নিকট হইতে লাভ করিয়াছিলেন । এই জনক, বিশ্বামিত্র ও রামচন্দ্ৰ যে পরস্পরের সমসাময়িক ছিলেন সে কথা হয়তো-বা কালগত ইতিহাসের দিক দিয়া সত্য নহে, কিন্তু ভাবগত ইতিহাসের দিক দিয়া এই তিন ব্যক্তি পরস্পরের নিকটবতী । আকাশের যুষ্মনক্ষত্রগুলিকে কাছে হইতে দেখিতে গেলে মাঝখানকার ব্যবধানে তাহাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখায়- তাহারা যে জোড়া তাহা দূর হইতে সহজেই দেখা যায়। জাতীয় ইতিহাসের আকাশেও এইরূপ অনেক জোড়া নক্ষত্র আছে, কালের ব্যবধানের দিক দিয়া দেখিতে গেলে তাহদের ঐক্য হারাইয়া যায়কিন্তু আভ্যন্তরিক যোগের আকর্ষণে তাহারা এক হইয়া মিলিয়াছে। জনক বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের যোগও যদি সেইরূপ কালের যোগ না হইয়া ভাবের যোগ হয় তবে তাহা আশ্চর্য নহে। ] এইরূপ ভাবগত ইতিহাসে ব্যক্তি ক্ৰমে ভাবের স্থান অধিকার করে। ব্রিটিশ পুরাণকথায় যেমন রাজা আর্থার। তিনি জাতির মনে ব্যক্তিরূপ ত্যাগ করিয়া ভাবরূপ ধারণ করিয়াছেন। জনক ও বিশ্বামিত্র সেইরূপ আৰ্য-ইতিহাসগত একটি বিশেষ ভাবের রূপক হইয়া উঠিয়াছেন। রাজা আর্থর মধ্যযুগের যুরোপীয়