পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় ¢ፃፃ ক্ষত্রিয়দের একটি বিশেষ খৃস্টীয় আদর্শদ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া তাহাকেই জয়যুক্ত করিবার জন্য বিরুদ্ধ পক্ষের সহিত লড়াই করিতেছেন এই যেমন দেখি, তেমনি ভারতে একদিন ক্ষত্রিয়দল ধর্মে এবং আচরণে একটি বিশেষ উচ্চ আদর্শক উদ্ভাবিত করিয়া তুলিয়া বিরোধিদলের সহিত দীর্ঘকাল ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসে তাহার আভাস পাওয়া যায়। এই সংগ্রামে ব্ৰাহ্মণেরই যে তঁহাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তাহারও প্রমাণ আছে। । তখনকার কালের নবক্ষত্রিয়দলের এই ভাবটা কী, তাহার পুরাপুরি সমস্তটা জােনা এখন অসম্ভব, কেননা বিপ্লবের জয়-পরাজয়ের পরে আবার যখন সকল পক্ষের মধ্যে একটা রফা হইয়া গেল তখন সমাজের মধ্যে বিরোধের বিষয়গুলি আর পৃথক হইয়া রহিল না এবং ক্ষতচিহ্নগুলি যত শীঘ্ৰ জোড়া লাগিতে পারে তাঁহারই । চেষ্টা চলিতে লাগিল। তখন নূতন দলের আদর্শকে ব্ৰাহ্মণের স্বীকার করিয়া লইয়া পুনরায় আপন স্থান গ্ৰহণ করিলেন । । তথাপি ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয়ের মধ্যে আদর্শের প্রভেদ কোন পথ দিয়া কী আকারে ঘটিয়াছিল তাহার একটা আভাস পাওয়া যায়। যজ্ঞবিধিগুলি কীেলিকবিদ্যা। এক-এক কুলের আর্যদলের মধ্যে এক-একটি কুলপতিকে আশ্রয় করিয়া বিশেষ বিশেষ স্তবমন্ত্র ও দেবতাদিগকে সন্তুষ্ট করিবার বিধিবিধান রক্ষিত ছিল। যাহারা এই সমস্ত ভালো করিয়া জানিতেন পীেরোহিত্যে তঁহাদেরই বিশেষ যশ ও ধন লাভের সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং এই ধর্মকার্য একটা বৃত্তি হইয়া উঠিয়াছিল এবং কৃপণের ধােনর মতো ইহা সকলের পক্ষে সুগম ছিল না। এই সমস্ত মন্ত্র ও যজ্ঞানুষ্ঠানের বিচিত্র বিধি বিশেষরূপে আয়ত্ত ও তাহা প্রয়োগ করিবার ভার স্বভাবতই একটি বিশেষ শ্রেণীর উপর ছিল। আত্মরক্ষা যুদ্ধবিগ্রহ ও দেশ-অধিকারে র্যাহাদিগকে নিয়ত নিযুক্ত থাকিতে হইবে তাহারা এই কাজের ভার লাইতে পারেন না, কারণ ইহা দীর্ঘকাল অধ্যয়ন ও অভ্যাস-সাপেক্ষ। কোনাে এক শ্রেণী এই সমস্তকে রক্ষা করিবার ভার যদি না লন তবে কৌলিকসূত্র ছিন্ন হইয়া যায় এবং পিতৃপিতামহদের সহিত যোগধারা নষ্ট হইয়া সমাজ শৃঙ্খলাভ্ৰষ্ট হইয় পড়ে। এই কারণে যখন সমাজের একশ্রেণী যুদ্ধ প্রভৃতি উপলক্ষে নব নব অধ্যবসায়ে নিযুক্ত তখন আর-এক শ্রেণী বংশের প্রাচীন ধর্ম এবং সমস্ত স্মরণীয় ব্যাপারকে বিশুদ্ধ ও অবিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবার জন্যই বিশেষভাবে প্রবৃত্ত হইলেন । . কিন্তু যখনই বিশেষ শ্রেণীর উপর এইরূপ কাজের ভার পড়ে তখনই সমস্ত জাতির চিত্তবিকাশের সঙ্গে তাহার ধর্মবিকাশের সমতনতায় একটা বাধা পড়িয়া যায়। কারণ সেই বিশেষ শ্রেণী ধৰ্মবিধিগুলিকে বঁধের । মতো এক জায়গায় দৃঢ় করিয়া বঁধিয়া রাখেন, সুতরাং সমস্ত জাতির মনের অগ্রসরগতির সঙ্গে তাহার সামঞ্জস্য থাকে না। ক্রমে ক্রমে অলক্ষ্যভাবে এই সামঞ্জস্য এতদূর পর্যন্ত নষ্ট হইয়া যায় যে, অবশেষে একটা বিপ্লব ব্যতীত সমন্বয়সাধনের উপায় পাওয়া যায় না। এইরূপে একদা ব্ৰাহ্মণেরা যখন আর্যদের চিরাগত প্ৰথা ও পূজাপদ্ধতিকে আগলাইয়া বসিয়াছিলেন, যখন সেই সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডকে ক্রমশই তাহারা কেবল জটিল ও বিস্তারিত করিয়া তুলিতেছিলেন তখন ক্ষত্রিয়েরা সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক ও মানুষিক বাধার সঙ্গে সংগ্রাম করিতে করিতে জয়োল্লাসে অগ্রসর হইয়া চলিতেছিলেন। এইজন্যই তখন আর্যদের মধ্যে প্রধান মিলনের ক্ষেত্র ছিল ক্ষত্ৰিয়সমাজ । শত্রুর সহিত যুদ্ধে যাহারা এক হইয়া প্ৰাণ দেয় তাহদের মতো এমন মিলন আর কাহারও হইতে পারে না । মৃত্যুর সম্মুখে যাহারা একত্র হয় তাহারা পরস্পরের অনৈককে বড়ো করিয়া দেখিতে পারে না। অপর পক্ষে সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মভাবে মন্ত্র দেবতা ও যজ্ঞকার্যের স্বাতন্ত্র্যরক্ষার ব্যবসায় ক্ষত্ৰিয়ের নহে, তাহারা মানবের বন্ধুরদুৰ্গম জীবনক্ষেত্রে নব নব ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে মানুষ, এই কারণে প্রথমূলক বাহানুষ্ঠানগত ভেদের বােধটা ক্ষত্রিয়ের মনে তেমন সুদৃঢ় হইয়া উঠিতে পারে না। অতএব আত্মরক্ষা ও উপনিবেশ-বিস্তারের উপলক্ষে সমস্ত আৰ্যদলের মধ্যকার ঐক্যসূত্রটি ছিল ক্ষত্রিয়দের হাতে। এইরূপে একদিন ক্ষত্রিয়েরাই সমস্ত অনৈক্যের অভ্যন্তরে একই যে সত্যপদাৰ্থ ইহা অনুভব করিয়াছিলেন। এইজন্য ব্ৰহ্মবিদ্যা বিশেষভাবে ক্ষত্রিয়ের বিদ্যা হইয়া উঠিয়া ঋক্, যজুঃ সাম প্রভৃতিকে অপরবিদ্যা বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে এবং ব্ৰাহ্মণ-কর্তৃক সযত্নে রক্ষিত হােম যাগ যজ্ঞ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডকে নিফল বলিয়া পরিত্যাগ করিতে চাহিয়াছে। ইহা হইতে স্পষ্টই দেখা যায় একদিন পুরাতনের সহিত নূতনের বিরোধ বধিয়াছিল।