পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৃহধর্মের ও সমাজধর্মের আশ্ৰয়রপে প্রচার করিবার চেষ্টা জাগিয়াছিল এবং রামচন্দ্ৰ যে একদা তাহার স্বজাতিকে বিদ্বেষের সংকোচ হইতে প্রেমের প্রসারণের দিকে লইয়া গিয়াছিলেন ও সেই নীতির দ্বারা একটি বিষম সমস্যার সমাধান করিয়া সমস্ত জাতির নিকট চিরকালের মতো করণীয় হইয়াছিলেন সে কথাটা সরিয়া গিয়াছে এবং ক্রমে ইহাই দাঁড়াইয়াছে যে তিনি শাস্ত্রানুমােদিত গাৰ্হত্যুের আশ্রয় ও লোকনুমােদিত আচারের রক্ষক। ইহার মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার এই, এককালে যে রামচন্দ্র ধর্মনীতি ও কৃষিবিদ্যাকে নূতন পথে চালনা করিয়াছে। একদিন সমাজে যিনি গতির পক্ষে বীৰ্য প্রকাশ করিয়াছিলেন আর-একদিন সমাজ তাহাকেই স্থিতির পক্ষে বীর বলিয়া প্রচার করিয়াছে। বস্তুত রামচন্দ্রের জীবনের কার্যে এই গতিস্থিতির সামঞ্জস্য ঘটিয়াছিল বলিয়াই এইরূপ হওয়া সম্ভবপর হইয়াছে। " তৎসত্ত্বেও এ কথা ভারতবর্ষ ভুলিতে পারে নাই যে তিনি চণ্ডালের মিতা, বানরের দেবতা, বিভীষণের বন্ধু ছিলেন। তিনি শক্রকে ক্ষয় করিয়াছিলেন এ তাহার গীেরব নহে তিনি শক্রকে আপন করিয়াছিলেন। তিনি আচারের নিষেধকে, সামাজিক বিদ্বেষের বাধাকে অতিক্রম করিয়াছিলেন ; তিনি আর্য অনার্যের মধ্যে গ্ৰীতির সেতু বন্ধন করিয়া দিয়াছিলেন। নৃতত্ত্ব আলোচনা করিলে দেখা যায় বর্বর জাতির অনেকেরই মধ্যে এক-একটি বিশেষ জন্তু পবিত্র বলিয়া পূজিত হয়। অনেক সময়ে তাহারা আপনাদিগকে সেই জন্তুর বংশধর বলিয়া গণ্য করে। সেই জন্তুর নামেই তাহারা আখ্যাত হইয়া থাকে। ভারতবর্ষে এইরূপে নাগবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। কিষ্কিন্ধ্যায় রামচন্দ্ৰ যে অনার্যদলকে বশ করিয়াছিলেন তাহারাও যে এইরূপ কারণেই বানর বলিয়া পরিচিত তাহাতে সন্দেহ নাই। কেবল তো বানর নহে রামচন্দ্রের দলে ভালুকও ছিল। বানর। যদি অবজ্ঞাসূচক আখ্যা হইত। তবে ভল্লুকের কোনো অর্থ পাওয়া যায় না । রামচন্দ্র এই যে বানর দিগকে বশ করিয়াছিলেন তাহা রাজনীতির দ্বারা নহে, ভক্তিধর্মের দ্বারা । এইরূপে তিনি হনুমানের ভক্তি পাইয়া দেবতা হইয়া উঠিয়াছিলেন। পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যায়, যে-কোনাে মহাত্মাই বাহ্যধর্মের স্থলে ভক্তিধর্মকে জাগাইয়াছেন তিনি স্বয়ং পূজা লাভ করিয়াছেন। শ্ৰীকৃষ্ণ, খৃস্ট, মহম্মদ, চৈতন্য প্রভৃতি তাহার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। শিখ, সুফি, কবীরপন্থী প্রভৃতি সর্বত্রই দেখিতে পাই, ভক্তি র্যাহাদিগকে আশ্রয় করিয়া প্রকাশ পায় অনুবতীদের কাছে তঁাহারা দেবত্ব প্রাপ্ত হন। ভগবানের সহিত ভক্তের অন্তরতম যোগ উদঘাটন করিতে গিয়া ঠাঁহারাও যেন দেবত্বের সহিত মনুষ্যত্বের ভেদসীমা অতিক্রম করিয়া থাকেন। এইরূপে হনুমান ও বিভীষণ রামচন্দ্রের উপাসক ও ভক্ত বৈষ্ণবরূপে খ্যাত হইয়াছেন। রামচন্দ্র ধর্মের দ্বারাই অনাৰ্যদিগকে জয় করিয়া তাহদের ভক্তি অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি বাহুবলে তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়া রাজ্যবিস্তার করেন নাই। দক্ষিণে তিনি কৃষিস্থিতিমূলক সভ্যতা ও ভক্তিমূলক একেশ্বরবাদ প্রচার করিয়াছিলেন। তিনি সেই যে বীজ রোপণ করিয়া আসিয়াছিলেন বহু শতাব্দী পরেও ভারতবর্ষ তাহার ফল লাভ করিয়াছিল। এই দাক্ষিণাত্যেক্রমে দারুণশৈবধর্মও ভক্তিধর্মের রূপ গ্ৰহণ করিল এবং একদা এই দাক্ষিণাত্য হইতেই ব্ৰহ্মবিদ্যার এক ধারায় ভক্তিস্রোত ও আর-এক ধারায় অদ্বৈতজ্ঞান উচ্ছসিত হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষকে প্লাবিত করিয়া দিল। " আমরা আর্যদের ইতিহাসে সংকোচ ও প্রসারণের এই একটি রূপ দেখিলাম। মানুষের এক দিকে তাহার বিশেষত্ব আর-এক দিকে তাহার বিশ্বত্ব এই দুই দিকের টানই ভারতবর্ষে যেমন করিয়া কাজ করিয়াছে তাহা যদি আমরা আলোচনা করিয়া না দেখি তবে ভারতবর্ষকে আমরা চিনিতেই পারিব না। একদিন তাহার এই আত্মরক্ষণ শক্তির দিকে ছিল ব্ৰাহ্মণ, আত্মপ্রসারণ শক্তির দিকে ছিল ক্ষত্ৰিয় । ক্ষত্রিয় যখন অগ্রসর হইয়াছে তখন ব্রাহ্মণ তাহাকে বাধা দিয়াছে কিন্তু বাধা অতিক্রম করিয়াও ক্ষত্রিয় যখন সমাজকে বিস্তারের দিকে লইয়া গিয়াছে তখন ব্ৰাহ্মণ পুনরায় নূতনকে আপন পুরাতনের সঙ্গে বধিয়া সমন্তটাকে আপনােকরিয়া লইয়া আবার একটা সীমা বধিয়া লইয়াছে। যুরোপীয়েরা যখন ভারতবর্ষে চিরদিন ব্ৰাহ্মণদের এই কাজটির আলোচনা করিয়াছেন ঠাহীরা এমনি ভাবে করিয়াছেন যেন এই ব্যাপারটা ব্ৰাহ্মণ নামক একটি বিশেষ ব্যবসায়ী দলের চাতুরী। তাহারা ইহা ভুলিয়া যান যে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয়ের যথার্থ জাতিগত ভেদ নাই, তাহারা একই জাতির