পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় ord অনার্যের সহিত বিবাহ সম্বন্ধে ক্ষত্রিয়ের প্রায় কোনাে বাধা ছিল না তাহা পুরাণে স্পষ্টই দেখা যায়। এইজন্য দেখা যায় বৌদ্ধযুগের পরবর্তী অধিকাংশ রাজবংশ ক্ষত্ৰিয়বংশ নহে। ] এদিকে শক জুন প্রভৃতি বিদেশীয় অনার্যগণ দলে দলে ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়া সমাজের মধ্যে অবাধে মিশিয়া যাইতে লাগিল- বৌদ্ধধর্মের কাটা খালদিয়া এই সমন্ত বন্যার জলনানা শাখায় একেবারে সমাজের মৰ্মস্থলে প্রবেশ করিল। কারণ, বাধা দিবার ব্যবস্থােটা তখন সমাজ-প্রকৃতির মধ্যে দুর্বল। এইরূপে ধর্মেকর্মে অনাৰ্যসংমিশ্রণ অত্যন্ত প্রবল হওয়াতে সর্বপ্রকার অদ্ভুত উন্মুঙ্খলতার মধ্যে যখন কোনাে সংগতির সূত্র রহিল। না তখনই সমাজের অস্তরস্থিত আৰ্যপ্রকৃতি অত্যন্ত পীড়িত হইয়া আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিল। আর্যপ্রকৃতি নিজেকে হারাইয়া ফেলিয়াছিল বলিয়াই নিজেকে সুস্পষ্টরূপে আবিষ্কার করিবার জন্য তাহার একটা চেষ্টা উদ্যত হইয়া উঠিল । আমরা কী এবং কোন জিনিসটা আমাদের- চারিদিকের বিপুল বিশ্লিষ্টতার ভিতর হইতে এইটােকে উদ্ধার করিবার একটা মহাযুগ আসিল। সেই যুগেই ভারতবর্ষ আপনাকে ভারতবর্ষ বলিয়া সীমচিহ্নিত করিল। তৎপূর্বে বৌদ্ধসমাজের যোগে ভারতবর্ষ পৃথিবীতে এত দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়ছিল যে সে আপনার কলেবরটাকে সুস্পষ্ট করিয়া দেখিতেই পাইতেছিল না। এইজন্য আর্যজনশ্রুতিতে প্রচলিত কোনো পুরাতন চক্রবর্তী সম্রাটের রাজ্যসীমার মধ্যে ভারতবর্ষ আপনার ভৌগােলিক সত্তাকে নির্দিষ্ট করিয়া লইল । তাহার পরে, সামাজিক প্ৰলয়বড়ে আপনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সূত্রগুলিকে খুঁজিয়া লইয়া জোড়া দিবার চেষ্টা চলিতে লাগিল। এই সময়েই সংগ্ৰহকর্তাদের কাজ দেশের প্রধান কাজ হইল। তখনকার যিনি ব্যাস, নূতন রচনা তাহার কাজ নহে পুরাতন সংগ্রহেই তিনি নিযুক্ত। এই ব্যাস একব্যক্তি না হইতে পারেন। কিন্তু ইনি সমাজের একই শক্তি। কোথায় আৰ্যসমাজের স্থিরপ্রতিষ্ঠা ইনি তাঁহাই খুজিয়া একত্র করিতে লাগিলেন। সেই চেষ্টার বশে ব্যাস বেদ সংগ্ৰহ করিলেন। যথাৰ্থ বৈদিককালে মন্ত্র ও যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রণালীগুলিকে সমাজ যত্ন করিয়া শিখিয়াছে ও রাখিয়ছে, তবু তখন তাহা শিক্ষণীয় বিদ্যমাত্র ছিল এবং সে বিদ্যাকেও সকলে পরাবিদ্যা বলিয়া মানিত না । কিন্তু একদিন বিশ্লিষ্ট সমাজকে ৰ্বাধিয়া তুলিবার জন্য এমন একটি পুরাতন শান্ত্রকে মাঝখানে দাড় করাইবার দরকার হইয়াছিল যাহার সম্বন্ধে নানা লোক নানাপ্রকার তর্ক করিতে পরিবে না- যাহা আৰ্যসমাজের সর্বপুরাতন বাণী ; যাহাকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করিয়া বিচিত্র বিরুদ্ধসম্প্রদায়ও এক হইয়া দাঁড়াইতে পরিবে। এইজন্য বেদ যদিচ প্ৰত্যহিক ব্যবহার হইতে তখন অনেক দূরবতী হইয়া পড়িয়ছিল তথাপি দূরের জিনিস বলিয়াই তাঁহাকে দূর হইতে মান্য করা সকলের পক্ষে সহজ হইয়াছিল। আসল কথা, যে জাতি বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল কোনাে একটি দৃঢ়নিশ্চল কেন্দ্রকে স্বীকার না করিলে তাহার পরিধি নির্ণয় কঠিন হয়। তাহার পরে আর্যসমাজে যত কিছু জনশ্রুতি খণ্ড খণ্ড আকারে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়ছিল তাহাদিগকেও একত্র করিয়া মহাভারত নামে সংকলিত করা হইল । যেমন একটি কেন্দ্রের প্রয়ােজন, তেমনি একটি ধারাবাহিক পরিধিসূত্ৰও তো চাই- সেই পরিধিসূত্রই ইতিহাস। তাই ব্যাসের আর-এক কাজ হইল ইতিহাস সংগ্ৰহ করা। আর্যসমাজের যত কিছু জনশ্রুতি ছড়াইয়া পড়িয়ছিল তাহাদিগকে তিনি এক করিলেন। শুধু জনশ্রুতি নহে, আৰ্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস, তৰ্কবিতর্ক ও চারিত্রনীতিকেও তিনি এইসঙ্গে এক করিয়া একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন । ইহার নাম দিলেন মহাভারত । এই নামের মধ্যেই তখনকার আর্যজাতির একটি ঐক্য উপলব্ধির চেষ্টা বিশেষভাবে প্রকাশ পাইতেছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সংজ্ঞা অনুসারে মহাভারত ইতিহাস না হইতে পারে। কিন্তু ইহা যথার্থই আৰ্যদের ইতিহাস। ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিবৃত্তান্ত। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি এই সমস্ত জনশ্রুতিকে গলাইয়া পোড়াইয়া বিশ্লিষ্ট করিয়া ইহা হইতে তথ্যমূলক ইতিহাস রচনা করিবার চেষ্টা করিত তবে আৰ্যসমাজের ইতিহাসের সত্য স্বরূপটি আমরা দেখিতে পাইতাম না। মহাভারত সংগ্রহের দিনে আর্যজাতির ইতিহাস আর্যজাতির স্মৃতিপটে যেরূপ রেখায় আঁকা ছিল, তাহার মধ্যে কিছু বা স্পষ্ট কিছু বা লুপ্ত, কিছু বা সুসংগত কিছু বা পরস্পরবিরুদ্ধ, মহাভারতে সেই সমস্তেরই প্ৰতিলিপি একত্র করিয়া রক্ষিত হইয়াছে।