পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6yr রবীন্দ্র-রচনাবলী যুদ্ধ এখন বাহিরে নহে যুদ্ধ এখন দেহের মধ্যে- কেননা অস্ত্ৰ এখন শরীরের মধ্যেই প্রবেশ করিয়াছে শত্রু এখন ঘরের ভিতরে। আর্য সভ্যতার পক্ষে ব্ৰাহ্মণ এখন একমাত্র। এইজন্য এই সময়ে বেদ যেমন অভ্রান্ত ধর্মশাস্ত্ররূপে সমােজস্থিতির সেতু হইয়া দাঁড়াইল, ব্ৰাহ্মণও সেইরূপ সমাজে সর্বোচ্চ পূজ্যপদ গ্রহণের চেষ্টা করিতে লাগিল। তখনকার পুরাণে ইতিহাসে কাব্যে সর্বত্রই এই চেষ্টা এমনি প্রবল আকারে পুনঃপুনঃ প্রকাশ পাইতেছে যে, স্পষ্টই বুঝা যায় যে তাহা একটা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্ৰয়াস, তাহা উজানস্রোতে গুণটানা, এইজন্য গুণবন্ধন অনেকগুলি এবং কঠিন টানের বিরামমাত্র নাই। ব্ৰাহ্মণের এই চেষ্টাকে কোনো একটি সাম্প্রদায়বিশেষের স্বার্থসাধন ও ক্ষমতালাভের চেষ্টা মনে করিলে ইতিহাসকে সংকীর্ণ ও মিথ্যা করিয়া দেখা হয়। এ চেষ্টা তখনকার সংকটগ্ৰস্ত আর্যজাতির অন্তরের চেষ্টা। ইহা আত্মরক্ষার প্রাণপণ প্ৰযত্ন। তখন সমস্ত সমাজের লোকের মনে ব্ৰাহ্মণের প্রভাবকে সর্বতোভাবে অক্ষুঃ করিয়া তুলিতে না পরিলে যাহা চারি দিকে ভাঙিয়া পড়িতেছিল তাহাকে জুড়িয়া তুলিবার কোনো উপায় ছিল না। 赖 এই অবস্থায় ব্ৰাহ্মণদের দুইটি কাজ হইল। এক, পূর্বধারাকে রক্ষা করা, আর এক, নূতনকে তাহার সহিত মিলাইয়া লওয়া । জীবনীপ্রক্রিয়ার এই দুইটি কাজই তখন অত্যন্ত বাধাগ্ৰস্ত হইয়া উঠিয়ছিল বলিয়াই ব্ৰাহ্মণের ক্ষমতা ও অধিকারকে এমন অপরিমিত করিয়া তুলিতে হইয়াছিল। অনার্য-দেবতাকে বেদের প্রাচীন মঞ্চে তুলিয়ালওয়া হইল, বৈদিক রুদ্র উপাধি গ্রহণ করিয়া শিব আর্য-দেবতার দলে স্থান পাইলেন। এইরূপে ভারতবর্ষে সামাজিক মিলন ব্ৰহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরে রূপ গ্ৰহণ করিল। ব্ৰহ্মায় আৰ্যসমাজের আরম্ভকাল, বিষ্ণুতে মধ্যাহ্নকাল, এবং শিবে তাহার শেষ পরিণতির রূপ রহিল। শিব। যদিচ রুদ্রনামে আর্যসমাজে প্রবেশ করিলেন তথাপি তাহার মধ্যে আর্য ও অনার্য এই দুই মূর্তিই স্বতন্ত্র হইয়া রহিল। আর্যের দিকে তিনি যোগীশ্বর, কামকে ভস্ম করিয়া নির্বাণের আনন্দে নিমগ্ন, তাহার দিগবাস সন্ন্যাসীর ত্যাগের লক্ষণ; অনার্যের দিকে তিনি বীভৎস, রক্তাক্ত গজাজিনধারী, গঞ্জিকা ও ভাঙ ধুতুরায় উন্মত্ত। আর্যের দিকে তিনি বুদ্ধেরই প্রতিরূপ এবং সেই রূপেই তিনি সর্বত্র সহজেই বুদ্ধমন্দির সকল অধিকার করিতেছেন ; অন্য দিকে তিনি ভূত প্ৰেত প্রভৃতি শ্মশানচর সমস্ত বিভীষিকা এবং সর্পপূজা, বৃষপূজা, বৃক্ষপূজা, লিঙ্গপূজা প্রভৃতি আত্মসাৎ করিয়া সমাজের অন্তর্গত অনার্যদের সমস্ত তামসিক উপাসনাকে আশ্রয় দান করিতেছেন। এক দিকে প্রবৃত্তিকে শান্ত করিয়া নির্জনে ধানে জপে তাহার সাধনা; অন্য দিকে চড়কপূজা প্রভৃতি ব্যাপারে নিজেকে প্ৰমত্ত করিয়া তুলিয়া ও শরীরকে নানা প্রকারে ক্লেশ উত্তেজিত করিয়া নিদারুণভাবে তাহার আরাধনা ৷ - এইরূপে আৰ্য-অনার্যের ধারা গঙ্গাযমুনার মতো একত্র হইল। তবু তাহার দুই রঙ পাশাপাশি রহিয়া গেল। এইরূপে বৈষ্ণবধর্মের মধ্যেও কৃষ্ণের নামকে আশ্রয় করিয়া যে সমস্ত কাহিনী প্রবেশ করিল। তাহা পাণ্ডবসখ ভাগবতধর্মপ্রবর্তক বীরশ্ৰেষ্ঠ দ্বারকাপুরীর শ্ৰীকৃষ্ণের কথা নহে। বৈষ্ণবধর্মের একদিকে ভগবদগীতার বিশুদ্ধ অবিমিশ্র উচ্চ ধর্মতত্ত্ব রহিল, আর-এক দিকে অনাৰ্য আভীর গােপজাতির লোকপ্রচলিত দেবীলীলার বিচিত্র কথা তাহার সহিত যুক্ত হইল। শৈবধর্মকে আশ্রয় করিয়া যে জিনিসগুলি মিলিত হইল তাঁহা নিরাভরণ এবং নিদারুণ ; তাহার শান্তি এবং তাহার মত্ততা তাহার স্থাণুবৎ আচল স্থিতি এবং তাহার উদ্দাম তাণ্ডবনৃত্য উভয়ই বিনাশের ভাবসূত্রটিকে আশ্রয় করিয়া গাঁথা পড়িল। বাহিরের দিকে তাহা আসক্তিবন্ধন ছেদন ও মৃত্যু অন্তরের দিকে তাহা একের মধ্যে বিলয়- ইহাই আৰ্য-সভ্যতার অদ্বৈতসূত্র। ইহাই নেতি নেতির দিকত্যাগ ইহার আভরণ, শ্মশানেই ইহার বাস। বৈষ্ণব ধর্মকে আশ্রয় করিয়া লোকপ্রচলিত যে পুরাণকাহিনী আৰ্যসমাজে প্রতিষ্ঠিত হইল, তাহার মধ্যে প্রেমের, সৌন্দর্যের এবং যৌবনের লীলা ; প্রলয়পনাকের স্থলে সেখানে বাঁশির ধ্বনি ; ভূতপ্রেতের স্থলে সেখানে গােপিনীদের বিলাস ; সেখানে বৃন্দাবনের চিরবসন্ত এবং গোলোকধামের চির-ঐশ্বৰ্য; এইখানে আৰ্যসভ্যতার দ্বৈতসূত্র। 植 একটি কথা মনে রাখা আবশ্যক। এই যে আভীর সম্প্রদায়-প্রচলিত কৃষ্ণকথা বৈষ্ণবধর্মের সহিত মিশিয়া গিয়াছে তাহার কারণ, এই যে, এখানে পরস্পর মিশিবার একটি সত্যপথ ছিল। নায়ক-নায়িকার সম্বন্ধকে জীব ও ভগবানের সম্বন্ধের রূপক ভাবে পৃথিবীর নানা স্থানেই মানুষ স্বীকার করিয়াছে। আৰ্যবৈষ্ণব ভক্তির এই তত্ত্বটিকে অনার্যদের কাহিনীর সঙ্গে মিলিত করিয়া সেই সমস্ত কাহিনীকে একটি উচ্চতম সত্যের মধ্যে