পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

28 রবীন্দ্র রচনাবলী অপ্রিয় হয় তবে তাহা আমি নিঃসংকোচে বর্জন করিতে পারি। আচ্ছা বেশ, মনে করা যাক, ইংরেজ এবং আইরিশ ; ইংরেজের বিরুদ্ধে আইরিশের হয়তো একটি বিদ্বেষের ভাব আছে এবং তাহার কারণটার জন্য কোনো একজন বিশেষ ইংরেজ ব্যক্তিগতভাবে বিশেষরূপে দায়ী নহে; তাহার পূর্বপিতামহেরা আইরিশের প্রতি অন্যায় করিয়াছে এবং সম্ভবত এখনো অধিকাংশ ইংরেজ সেই অন্যায়ের সম্পূর্ণ প্রতিকার করিতে অনিচ্ছুক। এমন স্থলে যে ইংরেজ আইরিশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করেন তিনি আইরিশকে ঠাণ্ডা করিয়া দিবার জন্য বলেন না। আমি ইংরেজ নই ; তিনি বাক্যে ও ব্যবহারে জানাইতে থাকেন তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। বস্তুত এরূপ স্থলে স্বজাতির অধিকাংশের বিরুদ্ধে আইরিশের পক্ষ লওয়াতে স্বজাতির নিকট হইতে দণ্ডভোগ করিতে হইবে, তাহাকে সকলে গালি দিবে, তীহাকে Little Englander-এর দলভুক্ত ও স্বজাতির গৌরবনাশক বলিয়া সকলে নিন্দা করিবে, কিন্তু তবু এ কথা তঁহাকে বলা সাজিবে না, আমি ইংরেজ নাহি। তেমনি হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের যদি বিরোধ থাকে, তবে আমি হিন্দু নাই বলিয়া সে বিরোধ মিটাইবার ইচ্ছা করাটা অত্যন্ত সহজ পরামর্শ বলিয়া শোনায় কিন্তু তাহা সত্য পরামর্শনহে। এইজন্যই সে পরামর্শ সত্য ফল পাওয়া যায় না। কারণ, আমি হিন্দু নাই বলিলে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা যেমন তেমনই থাকিয়া যায়, কেবল আমিই একলা তাহা হইতে পাশ কাটাইয়া আসি। । এ স্থলে অপর পক্ষে বলিবেন, আমাদের আসল বাধা ধর্ম লইয়া। হিন্দুসমাজ যাহাকে আপনার ধর্ম বলে আমরা তাহকে আপনার ধর্ম বলিতে পারি না। অতএব আমরা ব্ৰাহ্ম বলিয়া নিজের পরিচয় দিলেই সমস্ত গোল চুকিয়া যায় ; তাহার দ্বারা দুই কাজই হয়। এক, হিন্দুর যে ধর্ম আমার বিশ্বাসবিরুদ্ধ তাহাকে অস্বীকার করা হয় এবং যে ধর্মকে আমি জগতে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলিয়া জানি তাহাকেও স্বীকার করিতে পারি। এ সম্বন্ধে ভাবিবার কথা এই যে, হিন্দু বলিলে আমি আমার যে পরিচয় দিই, ব্ৰাহ্ম বলিলে সম্পূর্ণ তাহার অনুরূপ পরিচয় দেওয়া হয় না, সুতরাং একটি আর-একটির স্থান গ্ৰহণ করিতে পারে না। যদি কাহাকে জিজ্ঞাসা করা যায়, “তুমি কি চৌধুরীবংশীয়, আর সে, যদি তাহার উত্তর দেয়, না। আমি দপ্তরির কাজ করি, তবে প্রশ্নোত্তরের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য হয় না। হইতে পারে চৌধুরী বংশের কেহ আজ পর্যন্ত দপ্তরির কাজ করে নাই, তাই বলিয়া তুমি দপ্তরি হইলেই যে চৌধুরী হইতে পরিবেই না এমন কথা হইতে পারে না। তেমনি, আদ্যকার দিনে হিন্দুসমােজ যাহাকে আপনার ধর্ম বলিয়া স্থির করিয়াছে তাঁহাই যে তাহার নিত্য লক্ষণ তাহা কখনোই সত্য নহে। এ সম্বন্ধে বৈদিককাল হইতে অদ্য পর্যস্তের ইতিহাস হইতে নজির সংগ্ৰহ করিয়া পাণ্ডিত্যের অবতারণা করিতে ইচ্ছাই করি না । আমি একটা সাধারণতত্ত্বস্বরূপেই বলিতে চাই, কোনো বিশেষ ধৰ্মত ও কোনাে বিশেষ আচার কোনাে জাতির নিত্য লক্ষণ হইতেই পারে না। হাঁসের পক্ষে জলে সীতার যেমন, মানুষের পক্ষে বিশেষ ধর্মমত কখনোই সেরূপ নহে। ধর্মমত জড় পদার্থ নহে- মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি অবস্থার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার বিকাশ আছে- এইজন্য ধর্ম কোনো জাতির অবিচলিত নিত্য পরিচয় হইতেই পারে না। এইজন্য যদিচ সাধারণত সমস্ত ইংরেজের ধর্ম খৃস্টানধর্ম, এবং সেই ধর্মমতের উপরেই তাহার সমাজবিধি প্রধানত প্রতিষ্ঠিত তথাপি একজন ইংরেজ বীেদ্ধ হইয়া গেলে তাহার যত অসুবিধাই হউক তবু সে ইংরেজই থাকে। তেমনি ব্রাহ্মধর্ম আপাতত আমার ধর্ম হইতে পারে, কিন্তু কাল আমি প্রটেস্টান্ট পরশু রোম্যানক্যাথলিক এবং তাহার পর দিনে আমি বৈষ্ণব হইতে পারি, তাহাতে কোনো বাধা নাই, অতএব সে পরিচয় আমার সাময়িক পরিচয়- কিন্তু জাতির দিক দিয়া আমি অতীতের ইতিহাসে এক জায়গায় বাধা পড়িয়ছি, সেই সুবৃহৎকালব্যাপী সত্যকে নড়াইতে পারি এমন সাধ্য আমার নাই। । হিন্দুরা এ কথা বলে বটে। আমার ধর্মটা অটল ; এবং অন্য ধর্ম গ্ৰহণ করিলে তাহারা আমাকে অহিন্দু বলিয়া ত্যাগ করে। কিন্তু পূর্বেই বলিয়ছি। তাঁহাদের এই আচরণ আমার হিন্দু পরিচয়কে স্পর্শমাত্র করিতে পারে না। অনেক দিন পর্যন্ত হিন্দুমাত্রই বৈদ্যমতে ও মুসলমান হাকিমমতে আপনাদের চিকিৎসা করিয়া আসিয়াছে। এমনকি, এমন নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা থাকিতে পারেন যিনি ডাক্তারি ঔষধ স্পর্শ করেন না। তথাপি অভিজ্ঞতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুজাতির চিকিৎসা-প্ৰণালী বিস্তার লাভ করিয়াছে। আজও ইহা