পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় :: toళి যে আপনাকে পর করে সে পরকে আপনার করে না, যে আপন ঘরকে অস্বীকার করে কখনােই বিশ্ব তাহার ঘরে আতিথ্য গ্ৰহণ করিতে আসে না ; নিজের পদরক্ষার স্থানটুকুকে পরিত্যাগ করার দ্বারাই যে চরাচরের বিরাট ক্ষেত্ৰকে অধিকার করা যায় এ কথা কখনোই শ্ৰদ্ধেয় হইতে পারে না। SOS à श्लूि-विश्वदिनालश আজকালকার দিনে পৃথিবী জুড়িয়া আনাগোনা মেলামেশা চলিতেছে। মানুষের নানা জাতি নানা উপলক্ষে পরস্পরের পরিচয় লাভ করিতেছে। অতএব ভিন্ন ভিন্ন জাতির স্বাতন্ত্র্য ঘুচিয়া গিয়া পরস্পর মিলিয়া যাইবার সময় এখন উপস্থিত হইয়াছে। এ কথা মনে করা যাইতে পারিত। কিন্তু আশ্চর্য এই, বাহিরের দিকে দরজা যতই খুলিতেছে, প্রাচীর যতই ভাঙিতেছে, মানুষের জাতিগুলির স্বাতন্ত্র্যবােধ ততই যেন আরো প্রবল হইয়া উঠিতেছে। এক সময় মনে হইত মিলিবার উপায় ছিল না। বলিয়াই মানুষেরা পৃথক হইয়া আছে কিন্তু এখন মিলিবার বাধা-সকল যথাসম্ভব দূর হইয়াও দেখা যাইতেছে, পার্থক্য দূর হইতেছে না। যুরোপের যে-সকল রাজ্যে খণ্ড খণ্ড জাতিরা একপ্রকার মিলিয়া ছিল এখন তাহারা প্রত্যেকেই আপন স্বতন্ত্র আসন গ্ৰহণ করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে। নরোয়ে সুইডেনে ভাগ হইয়া গিয়াছে। আয়ার্লন্ড আপনার স্বতন্ত্র অধিকার লাভের জন্য বহুদিন হইতে অশ্ৰান্ত চেষ্টা করিতেছে। এমনকি, আপনার বিশেষ ভাষা, বিশেষ সাহিত্যকে আইরিশরা জাগাইয়া তুলিবার প্রস্তাব করিতেছে। ওয়েলসবাসীদের মধ্যেও সে চেষ্টা দেখিতে পাওয়া যায়। বেলজিয়ামে এতদিন একমাত্র ফরাসি ভাষার প্রাধান্য প্রবল ছিল ; আজ ফ্লেমিশরা নিজের ভাষার স্বাতন্ত্র্যকে জয়ী করিবার জন্য উৎসাহিত হইয়াছে; অষ্ট্ৰীয়া রাজ্যে বহুবিধ ছোটো ছােটাে জাতি একসঙ্গে বাস করিয়া আসিতেছে- তাহাদিগকে এক করিয়া মিলাইয়া ফেলিবার সম্ভাবনা আজ স্পষ্টই দূরপরাহত হইয়াছে। রুশিয়া আজ ফিনদিগকে আত্মসাৎ করিবার জন্য বিপুল বল প্রয়ােগ করিতেছে বটে। কিন্তু দেখিতেছে গেলা যত সহজ পরিপাক করা তত সহজ নহে। তুরস্ক সাম্রাজ্যে যে নানা জাতি বাস করিতেছে বহু রক্তপাতেও তাঁহাদের ভেদচিহ্ন বিলুপ্ত হইতে চাহিতেছে না। ইংলন্ডে হঠাৎ একটা ইল্পীরিয়ালিজমের ঢেউ উঠিয়ছিল। সমুদ্রপরের সমুদয় উপনিবেশগুলিকে এক সাম্রাজ্যতন্ত্রে বঁাধিয়া ফেলিয়া একটা বিরাট কলেবর ধারণ করিবার প্রলোভন ইংলন্ডের চিত্তে প্রবল হইয়া উঠিতেছিল। এবারে উপনিবেশগুলির কর্তৃপক্ষেরা মিলিয়া ইংলন্ডে যে এক মহাসমিতি বসিয়াছিল তাঁহাতে যতগুলি বন্ধনের প্রস্তাব হইয়াছে তাহার কোনােটাই টিকিতে পারে নাই। সাম্রাজ্যকে এককেন্দ্রগত করিবার খাতিরে যেখানেই উপনিবেশগুলির স্বাতন্ত্র্য হানি হইবার লেশমাত্র আশঙ্কা দেখা দিয়াছে সেইখানেই প্রবল আপত্তি উঠিয়াছে। একান্ত মিলনেই যে সবলতা এবং বৃহৎ হইলেই যে মহৎ হওয়া যায় এ কথা এখনকার কথা নহে। আসল কথা, পার্থক্য যেখানে সত্য, সেখানে সুবিধার খাতিরে, বড়ো দল বঁধিবার প্রলোভনে তাহাকে চোখ বুজিয়া লোপ করিবার চেষ্টা করিলে সত্য তাঁহাতে সম্মতি দিতে চায় না। চাপ-দেওয়া পার্থক্য ভয়ানক একটা উৎপাতক পদার্থ, তাহা কোনো-না-কোনো সময়ে ধাক্কা পাইলে হঠাৎ ফাটিয়া এবং ফাটাইয়া একটা বিপ্লব বাধাইয়া তােলে। যাহারা বস্তুতই পৃথক, তাহাদের পার্থক্যকে সম্মান করাই মিলনুরক্ষার সদুপায়। আপনার পার্থক্য যখন মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করে তখনই সে বড়ো হইয়া উঠিতে চেষ্টা করে। । আপনার পার্থক্যের প্রতি যাহার কোনো মমতা নাই সেই হাল ছাড়িয়া দিয়া দশের সঙ্গে মিশিয়া একাকার হইয়া যায়। নিদ্রিত মানুষের মধ্যে প্রভেদ থাকে না- জাগিয়া উঠিলেই প্রত্যেকের ভিন্নতা নানা প্রকারে আপনাকে ঘোষণা করে। বিকাশের অর্থই ঐক্যের মধ্যে পার্থক্যের বিকাশ। বীজের মধ্যে বৈচিত্র্য নাই।