পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় । ৬২৩ বাংলার অভাব ও অভিযোগ সম্বন্ধে সকলে মিলিয়া আলোচনা করিয়া বাঙালির চােখ ফুটাইয়া দেওয়া। বহুকাল পর্যন্ত এই নিতান্ত সাদা কথাটা কিছুতেই আমাদের মনে আসে নাই যে, তা করিতে হইলে বাংলা ভাষায় আলোচনা করা চাই। তার কারণ, দেশের লোককে দেশের লোক বলিয়া সমন্ত চৈতন্য দিয়া আমরা বুঝি না। এইজনাই দেশের পুরা দাম দেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। যাচাহিতেছি তা পেট ভরিয়া পাইনা তার কারণ এ নয় যে, দাতা প্রসন্নমনে দিতেছে না- তার কারণ এই যে, আমরা সত্যমনে চাহিতেছি না। বিদ্যাবিস্তারের কথাটা যখন ঠিকমত মন দিয়া দেখি তখন তাঁর সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখিতে পাই যে, তার বািহনটা ইংরেজি। বিদেশী মাল জাহাজে করিয়া শহরের ঘাট পর্যন্ত আসিয়া পীেহিতে পারে। কিন্তু সেই জাহাজটাতে করিয়াই দেশের হাটে হাটে আমদানি রপ্তানি করাইবার দুয়াশা মিথ্যা। যদি বিলিতি জাহাজটাকেই কায়মনে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাই। তবে ব্যাবসা শহরেই আটকা পড়িয়া থাকিবে। এ পর্যন্ত এ অসুবিধাটাকে আমাদের অসুখ বোধ হয় নাই। কেননা মুখে যাই বলি মনের মধ্যে এই শহরটািকেই দেশ বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলাম। দক্ষিণ্য যখন খুব বেশি হয় তখন এই পর্যন্ত বলি, আচ্ছা বেশ, খুব গোড়ার দিকের মোটা শিক্ষাটা বাংলা ভাষায় দেওয়া চলিবে কিন্তু সে যদি উচ্চশিক্ষার দিকে হাত বাড়ায় তবে গমিষ্যত্যুপহাস্যতম। আমাদের এই ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? ভরসা করিয়া এটুকু কোনোদিন বলিতে পারিব না। যে, উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে ? পশ্চিম হইতে যা-কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তার দেশী ভাষার আধারে বাধাই করিতে পারিয়াছে। অথচ জাপানি ভাষার ধারণাশক্তি আমাদের ভাষার চেয়ে বেশি নয়। নূতন কথা সৃষ্টি করিবার শক্তি আমাদের ভাষায় অপরিসীম। তাছাড়া য়ুরোপের বুদ্ধিবৃত্তির আকারপ্রকার যতটা আমাদের সঙ্গে মেলে এমন জাপানির সঙ্গে নয়। কিন্তু উদযোগী পুরুষসিংহ কেবলমাত্র লক্ষ্মীকে পায় না। সরস্বতীকেও পায়। জাপান জোর করিয়া বলিল যুরোপের বিদ্যাকে নিজের বাণীমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিব। যেমন বলা তেমনি করা, তেমনি তার ফললাভ। আমরা ভরসা করিয়া এ পর্যন্ত বলিতেই পারিলাম না যে, বাংলাভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে । আমাদের ভরসা এতই কম যে, ইস্কুল-কলেজের বাহিরে আমরা যে-সব লোকশিক্ষার আয়োজন করিয়াছি সেখানেও বাংলাভাষার প্রবেশ নিষেধ। বিজ্ঞানশিক্ষাবিস্তারের জন্য দেশের লোকের চাঁদায় বহুকাল হইতে শহরে এক বিজ্ঞানসভা খাড়া দাড়াইয়া আছে। প্রাচ্যদেশের কোনো কোনো রাজার মতো গীেরবনাশের ভয়ে জনসাধারণের কাছে সে বাহির হইতেই চায় না। বরং অচল হইয়া থাকিবে তবু কিছুতে সে বাংলা বলিবে না। ও যেন বাঙালির চাঁদা দিয়া বঁধানো পাকা ভিতের উপর বাঙালির অক্ষমতা ও ঔদাসীন্যের স্মরণস্তম্ভের মতো স্থাণু হইয়া আছে। কথাও বলে না, নড়েও না। উহাকে ভুলিতেও পারি না, উহাকে মনে রাখাও শক্ত । ওজর এই যে, বাংলাভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষা অসম্ভব। ওটা অক্ষামের ভীরুর ওজর । কঠিন বৈকি, সেইজনেই কঠোর সংকল্প চাই। একবার ভাবিয়া দেখুন, একে ইংরেজি তাতে সায়াল, তার উপরে, দেশে যে-সকল বিজ্ঞানবিশারদ আছেন তঁরা জগদবিখ্যাত হইতে পারেন। কিন্তু দেশের কোণে এই যে একটুখানি বিজ্ঞানের নীড় দেশের লোক বধিয়া দিয়াছে এখানে তঁদের ফলাও জায়গা নাই, এমন অবস্থায় এই পদার্থটা বঙ্গসাগরের তলায় যদি ডুব মারিয়া বসে। তবে ইহার সাহায্যে সেখানকার মৎস্যশাবকের বৈজ্ঞানিক উন্নতি আমাদের বাঙালির ছেলের চেয়ে যে কিছুমাত্র কম হইতে পারে এমন অপবাদ দিতে পারিব R | ቆ፡ মাতৃভাষা বাংলা বলিয়াই কি বাঙালিকে দণ্ড দিতেই হইবে ? এই অজ্ঞানকৃত অপরাধের জন্য সে চিরকাল অজ্ঞান হইয়াই থাক-সমস্ত বাঙালির প্রতি কয়জন শিক্ষিত বাঙালির এই রায়ই কিবহাল রহিল ? যে বেচারা বাংলা বলে সেই কি আধুনিক মনুসংহিতার শূদ্র ? তার কানে উচ্চশিক্ষার মন্ত্ৰ চলিবে না ? মাতৃভাষা হইতে ইংরেজি ভাষার মধ্যে জন্ম লইয়া। তবেই আমরা দ্বিজ হই ? বলা বাহুল্য ইংরেজি আমাদের শেখ চাই- শুধু পেটের জন্য নয়। কেবল ইংরেজি কেন ? ফরাসি