পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

08 রবীন্দ্ররচনাবলী সংসারে স্থাবর অস্থাবর দুই জাতের মানুষ আছে, অতএব বর্তমান অবস্থাটা ভালো কি মন্দ তা নিয়ে মতভেদ থাকবেই। কিন্তু মত নিয়ে করব কী? যেখানে একদিন ডাঙা ছিল সেখানে আজ যদি জল হয়েই থাকে। তবে সেখানকার পক্ষে দামি চীেঘুড়ির চেয়ে কলার ভোলাটাও যে ভালো। – পঞ্চাশ বছর আগে একদিন ছিল যখন বড়ো বড়ো গাইয়ে বাজিয়ে দূরদেশ থেকে কলকাতা শহরে আসত। ধনীদের ঘরে মজলিস বসত, ঠিক সমে মাথা নড়তে পারে এমন মাথা গুনতিতে নেহাত কম ছিল না। এখন আমাদের শহরে বক্তৃতাসভার অভাব নেই, কিন্তু গানের মজলিস বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত তনমানলয় সমেত বৈঠকি গান পুরোপুরি বরদাস্ত করতে পারে এতবড়ো মজবুত লোক এখনকার যুবকদের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না । চর্চা নেই বলে জবাব দিলে আমি শুনব না। মন নেই বলেই চর্চা নেই। আকবরের রাজত্ব গেছে। এ কথা আমাদের মানতেই হবে। খুব ভালো রাজত্ব, কিন্তু কী করা যাবে- সে নেই। অথচ গানেতেই যে সে রাজত্ব বহাল থাকবে এ কথা বললে অন্যায় হবে। আমি বলছি নে আকবরের আমলের গান লুপ্ত হয়ে যাবে- কিন্তু এখনকার কালের সঙ্গে যোগ রেখে তাকে টিকতে হবে- সে যে বর্তমান কালের মুখ বন্ধ করে দিয়ে নিজেরই পুনরাবৃত্তিকে অন্তহীন করে তুলবে তা হতেই পারবে না। সাহিত্যের দিক থেকে উদাহরণ দিলে আমার কথাটা স্পষ্ট হবে। আজ পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যদি কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসানের পুনরাবৃত্তি নিয়ত চলতে থাকত তা হলে কী হত ? পনেরো-আনা লোক সাহিত্য পড়া ছেড়েই দিত। বাংলার সকল গল্পই। যদি বাসবদত্ত-কাদম্বরীর ছাচে ঢালা হত তা হলে জাতে ঠেলার ভয় দেখিয়ে সে গল্প পড়াতে হত । কবিকঙ্কণ চণ্ডী, কাদম্বরীর আমি নিন্দা করছি নে। সাহিত্যের শোভাযাত্রার মধ্যে চিরকালই তাদের একটা স্থান আছে কিন্তু যাত্রাপথের সমস্তটা জুড়ে তারাই যদি আড়া করে বসে, তা হলে সে পথটাই মাটি, আর তাদের আসরে কেবল তাকিয়া পড়ে থাকবে, মানুষ থাকবে না। : বঙ্কিম আনলেন সাতসমুদ্রপারের রাজপুত্রকে আমাদের সাহিত্য-রাজকন্যার পালঙ্কের শিয়রে। তিনি যেমনি ঠেকালেন সোনার কাঠি, অমনি সেই বিজয়-বসন্ত লয়লামজনুর হাতির দাঁতে বাধানো পালঙ্কের উপর রাজকন্যা নড়ে উঠলেন। চলতিকালের সঙ্গে তার মালা-বদল হয়ে গেল, তার পর থেকে তঁকে আজ আর ঠেকিয়ে রাখে কে ? . যারা মনুষ্যত্বের চেয়ে কৌলীন্যকে বড়ো করে মানে তারা বলবে ঐ রাজপুত্রটা যে বিদেশী ! তারা এখনো বলে, এ সমস্তই ভুয়ো ; বস্তুতন্ত্র যদি কিছু থাকে তো সে ঐ কবিকঙ্কণ চণ্ডী, কেননা এ আমাদের খাটি মাল। তাদের কথাই যদি সত্য হয় তা হলে এ কথা বলতেই হবে নিছক খাটি বস্তুতন্ত্রকে মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ তাকেই চায় যা বস্তু হয়ে বাস্তু গেড়ে বসে না, যা তার প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে চলে, যা তাকে মুক্তির স্বাদ 4বিদেশের সোনার কাঠি যে জিনিসকে মুক্তি দিয়েছে সে তো বিদেশী নয়- সে যে আমাদের আপনি প্ৰাণ। তার ফল হয়েছে এই যে, যে বাংলাভাষাকে ও সাহিত্যকে একদিন আধুনিকের দল ষ্টুতে চাইত না এখন তাকে নিয়ে সকলেই ব্যবহার করছে ও গীেরব করছে। অথচ যদি ঠাহর করে দেখি তবে দেখতে পাব গদ্যে পদ্যে সকল জায়গাতেই সাহিত্যের চালচলন সাবেক কালের সঙ্গে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ধারা তাকে জাতিচু্যত বলে নিন্দা করেন ব্যবহার করবার বেলা তাকে তঁরা বর্জন করতে পারেন না। সমুদ্রপারের রাজপুত্র এসে মানুষের মনকে সোনার কাঠিটুইয়ে জাগিয়ে দেয় এটা তার ইতিহাসে চিরদিন ঘটে আসছে। আপনার পূর্ণ শক্তি পাবার জন্যে বৈষম্যের আঘাতের অপেক্ষা তাকে করতেই হয়। কোনো সভ্যতাই একা আপনাকে আপনি সৃষ্টি করে নি। গ্ৰীসের সভ্যতার গোড়ায় অন্য সভ্যতা ছিল এবং গ্ৰীস বরাবর ইজিপ্ট ও এশিয়া থেকে ধাক্কা খেয়ে এসেছে। ভারতবর্ষে দ্রাবিড়মনের সঙ্গে আর্যমনের সংঘাত ও সন্মিলন ভারতসভ্যতা সৃষ্টির মূল উপকরণ, তার উপরে শ্ৰীস রোম পারস্য তাকে কেবলই নাড়া দিয়েছে। যুরোপীয় সভ্যতায় যেসব যুগকে পুনর্জন্মের যুগ বলে সেসমস্তই অন্য দেশ ও অন্যাকালের সংঘাতের যুগ। মানুষের মন বাহির হতে নাড়া পেলে তবে আপনার অন্তরকে সত্যভাবে লাভ করে এবং তার পরিচয় পাওয়া