পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

iO রবীন্দ্র-রচনাবলী ঋতুতে ঋতুতে যে ভেদ সে কেবল বর্ণের ভেদ নহে, বৃত্তিরও ভেদ বটে। মাঝে মাঝে বর্ণসংকর দেং দেয়া-জ্যৈষ্ঠের পিঙ্গল জটা শ্রাবণের মেঘদূপে নীল হইয়া উঠে, ফাঙ্গুনের শ্যামলতায় বৃদ্ধ পীেষ আপনা পীত রেখা পুনরায় ঢালাইবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্ৰকৃতির ধর্মীরাজ্যে এ-সমস্ত বিপর্যয় টেকে না। &ীষ্মকে ব্ৰাহ্মণ বলা যাইতে পারে। সমান্ত রাসবাহুল্য দমন করিয়া, জঞ্জাল মারিয়া তপস্যার আগু। জ্বলিয়া সে নিবৃত্তিমার্গের মন্ত্রসাধন করে। সাবিত্রী মন্ত্র জপ করিতে করিতে কখনো বা সে নিশ্বাস ধারা করিয়া রাখে, তখন গুমটি গাছের পাতা নড়ে না; আবার যখন সে রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়িয়া দেয় তখন পৃথিৱী কঁপিয়া উঠে । ইহার আহরের আয়োজনটা প্ৰধানত ফলাহার। বর্ধকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষ হয় না। তাহার নকিৰ আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাই, বাজাইতে আসে- মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তো নাই। দিগবিজয় করাই তাহার কাজ। লড়াই করিয়া সমন্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিকচক্রবর্তী হইয় বসে । তমালতালীবনরাজির নীলতম প্ৰান্ত হইতে তাহার রথের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, তাহার বঁাক তলোয়ারখানা ক্ষণে ক্ষণে কোষ হইতে বাহির হইয়া দিগবাক্ষ বিদীর্ণ করিতে থাকে, আর তাহার তৃণ হইতে বরুণ-বাণ আর নিঃশেষ হইতে চায় না। এ দিকে তাহার পাদপীঠের উপর সবুজ কিংখাবের আস্তর বিছানো, মাথার উপরে ঘনপল্লবশ্যামল চন্দ্ৰতাপে সোনার কদম্বের ঝালর বুলিতেছে, আর বন্দিনী পূর্বদিগব পাশে দাড়াইয়া অশ্রনয়নে তাহাকে কেতকীগন্ধবারিসিক্ত পাখা বীজন করিবার সময় আপন বিদ্যুন্মণিজড়ি কঙ্কণখনি বালকিয়া তুলিতেছে। 博 r আর শীতটা বৈশ্য । তাহার। পাকা ধান কাটাই মাড়াইয়ের আয়োজনের চারিটি প্রহর ব্যস্ত, কলাই য ছোলার প্রচুর আশ্বাসে ধরণীর ডালা পরিপূর্ণ। প্রাঙ্গণে গোলাভিরিয়া উঠিয়াছে, গোষ্ঠে গোরুর পাল রোম করিতেছে, ঘাটে ঘাটে নৌকা বোঝাই হইল, পথে পথে ভারে মন্থর হইয়া গাড়ি চলিয়াছে ; আর ঘরে ঘা নবায় এবং পিঠাপার্বণের উদযোগে টেকিশলা মুখরিত। এই তিনটিই প্রধান বর্ণ। আর শূদ্র যদি বল সে শরৎ ও বসন্ত। একজন শীতের, আর-একজন গ্ৰীষ্মে তলপি বহিয়া আনে। মানুষের সঙ্গে এইখানে প্রকৃতির তফাত। প্রকৃতির ব্যবস্থায় যেখানে সেবা সেইখানে সৌন্দর্য, যেখানে নম্রতা সেইখানেই গীেরব। তাহার সভায় শূদ্র যে, সে ক্ষুদ্র নহে, ভার যে বহন করে সম আভরণ তাঁহারই। তাই তো শরতের নীল পাগড়ির উপরে সোনার কলকা, বসন্তের সুগন্ধ পীত উত্তরীয়খf ফুলকটা। ইহার যে-পদুকা পরিয়া ধরণী-পথে বিচরণ করে তাহারঙ-বেরঙের সূত্রশিল্পে বুটিদার ; ইহাদে অঙ্গদে কুণ্ডলে অঙ্গুরীয়ে জহরতের সীমা নাই। এই তো পাচটার হিসাব পাওয়া গেল। লোকে কিন্তু ছয়টা ঋতুর কথাই বলিয়া থাকে। ওটা নেহা। জোড় মিলাইবার জন্য। তাহারা জানে না বেজোড় লইয়াই প্রকৃতির যত বাহার। ৩৬৫ দিনকে দুই দি ভাগ করে- ৩৬ পর্যন্ত বেশ মেলে। কিন্তু সাব-শেষের ঐ ছোট্ট পাঁচটি কিছুতেই বাগ মানিতে চায় না। দুইয়ে দুইয়ে মিল হইয়া গেলে সে মিল থামিয়া যায়, অলস হইয়া পড়ে। এইজন্য কোথা হইতে একটা তি আসিয়া সেটাকে নাড়া দিয়া তাহার যতরকম সংগীত সমন্তটা বাজাইয়া তোলে। বিশ্বসভায় অমিল শয়তানী এই কাজ করিবার জন্যই আছে- সে মিলের স্বৰ্গপুরীকে কোনােমতেই ঘুমাইয়া পড়তে দিবে না ; সেই হে নৃত্যপরা উর্বশীর নূপুরে ক্ষণে ক্ষণে তাল কটাইয়া দেয়- সেই বেতালটি সামলাইবার সময়েই সুরসভা তালের রস-উৎস উচ্ছসিত হইয়া উঠে। ছয় ঋতু গণনার একটা কারণ আছে। বৈশাকে তিন বর্ণের মধ্যে সব নীচে ফেলিলেও উহারই পরিমা বেশি। সমাজের নীচের বড়ো ভিত্তি ঐ বৈশ্য। এক দিক দিয়া দেখিতে গেলে সংবৎসরের প্রধান বিভা শরৎ হইতে শীত। বৎসরের পূর্ণ পরিণতি ঐখানে। ফসলের গোপন আয়োজন সকল ঋতুতেই কি ফসলের প্রকাশ হয়। ঐ সময়েই। এইজন্য বৎসরের এই ভাগটাকে মানুষ বিস্তারিত করিয়া দেখে। এ অংশেই বাল্য যৌবন বার্ধক্যের তিন মূর্তিতে বৎসরের সফলতা মানুষের কাছে প্রত্যক্ষ হয়। শরতে তাৰ