পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO রবীন্দ্র-রচনাবলী চক্ষের জলে তাদের বক্ষ ভাসে এবং তাদের পথঘাটেরও প্রায় সেই দশা। এমনি করিয়া দুঃখকে আমরা সর্বঙ্গে মাখি এবং ভাঙা পিপের আলকাতরার মতো সেটাকে দেশের চারদিকে গড়াইয়া ছড়াইয়া পড়তে श् ि। কথাটা শুনিতে ছােটাে, কিন্তু আসলে ছোটাে নয়। কোথাও আমাদের কোনো কর্তৃত্ব আছে এটা আমর কিছুতেই পুরামাত্রায় বুঝিলাম না। বইয়ে পড়িয়ছি, মাছ ছিল কাচের টবের মধ্যে ; সে অনেক মাথা খুঁড়িয় অবশেষে বুঝিল যে কাঁচটা জল নয়। তার পরে সে বড়ো জলাশয়ে ছাড়া পাইল, তবু তার এটা বুঝিন্তে সাহস হইল না যে, জলটা কঁাচ নয় ; তই সে একটুখানি জায়গাতেই ঘুরিতে লাগিল। ঐ মাথা ঠুকিবাং ভয়টা আমাদের হাড়েমাসে জড়ানাে, তাই যেখানে সীতার চলিতে পারে সেখানেও মন চলে না। অভিমনু মায়ের গর্ভেই বৃহে প্রবেশ করিবার বিদ্যা শিখিল, বাহির হইবার বিদ্যা শিখিল না, তাই সে সর্বঙ্গে সপ্তরিখী: মারটা খাইয়াছে। আমরাও জন্মিবার পূর্ব হইতেই বাধা-পড়বার বিদ্যাটাই শিখিলাম, গাঠ-খুলিবার বিদ্যাট নয় ; তার পর জন্মমাত্রই বুদ্ধিটা হইতে শুরু করিয়া চলাফেরাটা পর্যন্ত পাকে পাকে জড়াইলাম, আর সৌ হইতেই জগতে যেখানে যত রখী আছে, এমনকি, পদাতিক পর্যন্ত সকলের মারা খাইয়া মরিতেছি। মানুষকে পুঁথিকে, ইশারাকে, গণ্ডিকে বিনাবাক্যে পুরুষে পুরুষে মানিয়া চলাই এমনি আমাদের অভ্যস্ত যে, জগতে কোথাও যে আমাদের কর্তৃত্ব আছে তাহা চোখের সামনে সশরীরে উপস্থিত হইলেও কোনোমতেই ঠাহর হয় না, এমনকি, বিলাতি চশমা পরিলেও না। মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো কথাটাই এই যে, কর্তৃত্বের অধিকারই মনুষ্যত্বের অধিকার। নান মন্ত্রে, নানা শ্লোকে, নানা বিধিবিধানে এই কথাটা যে-দেশে চাপা পড়িল, বিচারে পাছে এতটুকু ভুল হয় এইজন্য যে-দেশে মানুষ আচারে আপনাকে আক্টেপিষ্ট বাঁধে, চলিতে গেলে পাছে দূরে গিয়া পড়ে এইজন নিজের পথ নিজেই ভাঙিয়া দেয়, সেই দেশে ধর্মের দোহাই দিয়া মানুষকে নিজের পরে অপরিসীম অশ্রদ্ধ করিতে শেখানাে হয় এবং সেই দেশে দাস তৈরি করিবার জন্য সকলের চেয়ে বড়ো কারখানা খােল হইয়াছে । আমাদের রাজপুরুষেরাও শাস্ত্রীয় গভীর্যের সঙ্গে এই কথাই বলিয়া থাকেন, “তোমরা ভুল করিবে: তোমরা পরিবে না, অতএব তোমাদের হাতে কর্তৃত্ব দেওয়া চলিবে না।” 观 আর যাই হােক, মনু-পরাশরের এই আওয়াজটা ইংরেজি গলায় ভারি বেসুর বাজে, তাই আমরা তাঁদের যে-উত্তরটা দিই সেটা তাদেরই সহজ সুরের কথা। আমরা বলি, ভুল করাটা তেমন সর্বনাশ নয় স্বাধীনকর্তৃ না পাওয়াটা যেমন । ভুল করিবার স্বাধীনতা থাকিলে তবেই সত্যকে পাইবার স্বাধীনতা থাকে। নিখুঁত নির্ভুক্ত হইবার আশায় যদি নিরঙ্কুশ নিজীব হইতে হয় তবে তার চেয়ে নাহয় ভুলই করিলাম। আমাদের বলিবার আরো কথা আছে। কর্তৃপক্ষদের এ কথাও স্মরণ করাইতে পারি যে, আজ তোমর আত্মকর্তৃত্বের মোটর-গড়ি চালাইতেছ। কিন্তু একদিন রাত-থাকিতে যখন গোরুর গাড়িতে যাত্রা শুরু হইয়াছিল তখন খালখন্দর মধ্য দিয়া চাকা দুটাের আর্তনাদ ঠিক জয়ধ্বনির মতো শোনাইত না। পার্লামেন্ট বরাবরই ডাইনে বঁায়ে প্রবল ঝাকানি খাইয়া এক নজির হইতে আর-এক নজিরের লাইন কাটিতে কাটিতে আসিয়াছে, গােড়াগুড়িই স্টিমরোলার টানা পাকা রাস্তা পায় নাই। কত ঘূষঘাষ, ঘুষানুষ, দলাদলি, অবিচা, এবং অব্যবস্থার মধ্য দিয়া সে হেলিয়া হেলিয়া চলিয়াছে। কখনো রাজা, কখনো গির্জা, কখনো জমিদার কখনো-বা মদওয়ালারও স্বাৰ্থ বহিয়াছে। এমন এক সময় ছিল সদস্যেরা যখন জরিমানা ও শাসনের ভয়ে পার্লামেন্টে হাজির হইত। আর গলদের কথা যদি বল, কবেকার কালে সেই আয়ার্লন্ড-আমেরিকার সম্বন্ধ হইতে আরম্ভ করিয়া আজকের দিনে বোয়ার যুদ্ধ এবং ডার্ডানেলিস মেসোপেটেমিয়া পর্যন্ত গলদের লম্ব ফৰ্দ দেওয়া যায় ; ভারতবিভাগের ফর্দটাও নেহাত ছােটাে নয়- কিন্তু সেটার কথায় কাজ নাই আমেরিকার রাষ্ট্ৰতন্ত্রে কুবের দেবতার চরগুলি যে-সকল কুকীর্তি করে সেগুলো সামান্য নয়। ড্রেফুসে নির্যাতন উপলক্ষে ফ্রান্সের রাষ্ট্ৰতন্ত্রে সৈনিক-প্রাধান্যের যে অন্যায় প্রকাশ পাইয়াছিল তাঁহাতে রিপূর্ণ অন্ধশক্তিরই তো হাত দেখা যায়। এ সকল সত্ত্বেও আজকের দিনে এ কথায় কারও মনে সন্দেহ লেশমাত্র নাই যে, আত্মকর্তৃত্বের চির-সচলতার বেগেই মানুষ ভুলের মধ্য দিয়াই ভুলকে কাটায়, অন্যায়ের গর্তে