পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম $ኃ(፩እ খড়মোড় ভাঙিয়া পড়িয়াও ঠেলাঠেলি কুরিয়া উপরে ওঠে। এইজন্য মানুষকে পিছমােড়া ধধিয়া তার মুখে পয়সান্ন তুলিয়া দেওয়ার চেয়ে তাকে স্বাধীনভাবে অন্ন উপার্জনের চেষ্টীয় উপবাসী হইতে দেওয়াও ভালো। এর চেয়েও একটা বড়ো কথা আমাদের বলিবার আছে- সে এই যে, রাষ্ট্ৰীয় আত্মকর্তৃত্বে কেবল যে সুব্যবস্থা বা দায়িত্ববোধ জন্মে তা নয়, মানুষের মনের আয়তন বড়ো হয়, কেবল পল্লীসমাজে বা ছোটাে ছােটাে সামাজিক শ্রেণীবিভাগে যাদের মন বদ্ধ রাষ্ট্ৰীয় কর্তৃত্বের অধিকার পাইলে তবেই মানুষকে বড়ো পরিধির মধ্যে দেখিবার তারা সুযোগ পায়। এই সুযোগের অভাবে প্রত্যেক মানুষ মানুষ হিসাবে ছােটাে হইয়া থাকে। এই অবস্থায় সে যখন মনুষ্যত্বের বৃহৎ ভূমিকার উপরে আপনি জীবনকে না ছড়াইয়া দেখে তখন তার চিন্তা তার শক্তি তার আশাভরসা সমস্তই ছোটাে হইয়া যায়। মানুষের এই আত্মার খর্বতা তার প্রাণনাশের চেয়ে ঢের বেশি বড়ো অমঙ্গল। ‘ভূমৈব সুখং নায়ে সুখমন্তি। অতএব ভুলচুকের সমস্ত আশঙ্কা মানিয়া লইয়াও আমরা আত্মকর্তৃত্ব চাই। আমরা পড়িতে পড়িতে চলিব- দোহাই তোমার, আমাদের এই পড়ার দিকেই তাকাইয়া আমাদের চলার দিকে বাধা দিয়ে না। এই জবাবই সত্য জবাব। যদি নাছােড়বান্দা হইয়া কোনাে একগুঁয়ে মানুষ এই জবাব দিয়া কর্তৃপক্ষকে বেজার করিয়া তোলে তবে সেদিক হইতে সেইনটার্নড় হইতে পারে কিন্তু এ দিক হইতে বাহবা পায়। অথচ ঠিক এই জবাবটাই যদি আমাদের সমাজকর্তাদের কাছে দাখিল করি, যদি বলি “তােমরা বল, যুগটা কলি, আমাদের বুদ্ধিটা কম, স্বাধীন বিচারে আমাদের ভুল হয়, স্বাধীন ব্যবহারে আমরা অপরাধ করি, অতএব মগজটাকে অগ্রাহা করিয়া পুঁথিটাকে শিরোধার্যকরিবার জন্যই আমাদের নতশিরটা তৈরি, কিন্তু এতবড়ো অপমানের কথা আমরা মানিব না, তবে চণ্ডীমণ্ডপের চক্ষু রাঙা হইয়া ওঠে এবং সমাজকর্তা তখনই সামাজিক ইনটার্নমেন্ট-এর হুকুম জারি করেন। ধারা পােলিটিকাল আকাশে উড়িবার জন্য পাখা ঝটপট করেন তারাই সামাজিক দাড়ের উপর পাদুটােকে শক্ত শিকলে জড়াইয়া রাখেন। আসল কথা নীেকাটাকে ডাইনে চালাইবার জন্যও যে হাল, বায়ে চালাইবার জন্যও সেই হল । একটা মূলকথা আছে সেইটােকে আয়ত্ত করিতে পারলেই সমাজেও মানুষ সত্য হয়, রাষ্ট্রব্যাপারেও মানুষ সত্য হয়। সেই মূলকথাটার ধারণা লইয়াই চিৎপুরের সঙ্গে চৌরঙ্গির তফাত। চিৎপুর একেবারেই ঠিক করিয়া আছে যে, সমস্তই উপরওয়ালার হাতে। তাই সে নিজের হাত খালি করিয়া চিৎ হইয়া রহিল। চৌরঙ্গি বলে, কিছুতে আমাদের হাত নাই এ যদি সত্যই হইত। তবে আমাদের হাত দুটােই থাকিত না। উপরওয়ালার হাতের সঙ্গে আমাদের হাতের একটা অবিচ্ছিন্ন যোগ আছে চৌরঙ্গি এই কথা মানে বলিয়াই জগৎটাকে হাত করিয়াছে, আর চিৎপুর তাহা মানে না বলিয়াই জগৎটাকে হাতছাড়া করিয়া দুই চক্ষুর তারা উলটাইয়া শিবনেত্ৰ হইয়া রহিল। আমাদের ঘরগড়া কুনো নিয়মকেই সব চেয়ে বড়ো মনে করিতে হইলে চােখ বুজিতে হয়। চােখ চাহিলে । দেখি, বিশ্বের আগাগোড়া একটা বৃহৎ নিয়ম আছে। নিজের চেষ্টায় সেই নিয়মকে দখল করাই শক্তিলাভ সমৃদ্ধিলাভ দুঃখ হইতে পরিত্রণ লাভ- এই নিশ্চিত বােধটাই বর্তমান যুরোপীয় সভ্যতার পাকা ভিত। ব্যক্তিবিশেষের সফলতা কোনাে বিশেষ বিধানে নয়, বিশ্ববিধানে— এইটে শক্ত করিয়া জানাতেই শক্তির ক্ষেত্রে য়ুরোপের এতবড়ো মুক্তি । আমরা কিন্তু দুই হাত উলটাইয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিতেছে-কর্তার ইচ্ছা কর্ম। সেই কর্তটিকেঘরের বাপদাদা, বা পুলিসের দারোগ, বা পাণ্ডা পুরোহিত, বা স্মৃতিরত্ন বা শীতলা মনসা ওলাবিবি দক্ষিণরায়, আিম লক্ষ্ম— কাঠি হাজার কেয়ক গল্প দিলে শক্তি হল কের হরিয়া আকালে দুইয়া দিই। : কলেজি পাঠক বলিবেন- আমরা তো এ সব মানি না। আমরা তো বসন্তুর টিকা লই ; ওলাউঠা হইলে নুনের জলের পিিচকিরি লইবার আয়োজন করি ; এমনকি মশাবাহিনী ম্যালেরিয়াকে আজও আমরা দেবী বলিয়া খাড়া করি নাই, তাকে আমরা কীটস্য কীট বলিয়াই গণ্য করি ; এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্ৰভরা তাবিজটাকে পেটভরা পিলের উপর বুলাইয়া রাখি । মুখে কোনোটাকে মানি বা নাই মানি তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঐ মানার বিষে আমাদের মনের -