পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম WS জনাই বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞানের জোরে যুরোপের মনে এতবড়ো একটা ভরসা জমিয়াছে যে, সে বলিতেছে হইতে দূর হইবেই মানুষের ঘরে যে-কেহ জমিবে সকলেই দেহে মনে সুস্থ সবল হইবে এবং রাষ্ট্রতত্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সহিত বিশ্বকল্যাণের সামঞ্জস্য সম্পূর্ণ হইয়া উঠিবে। . আধ্যাত্মিক অর্থে ভারতবর্ষ একদিন বলিয়াছিল, অবিদ্যাই বন্ধন, মুক্তি জ্ঞানে ; সত্যকে পাওয়াতেই আমাদের পরিত্রাণ। অসত্য কাকে বলে। নিজেকে একান্ত বিচ্ছিন্ন করিয়া জানাই অসত্য। সর্বভূতের সঙ্গে আত্মার মিল জানিয়া পরমাত্মার সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগটিকে জানাই সত্য জানা। এতবড়ো সত্যকে মনে আনিতে পারা যে কী পরমাশ্চর্য ব্যাপার তা আজ আমরা বুঝতেই পারিব না। এ দিকে আধিভৌতিক ক্ষেত্রে যুরোপ যে-মুক্তির সাধনা করিতেছে তারও মূল কথাটা এই একই। এখানেও দেখা যায় অবিদ্যাই বন্ধন, সত্যকে পাওয়াতেই মুক্তি। সেই বৈজ্ঞানিক সত্য মানুষের মনকে বিচ্ছিন্নতা হইতে বিশ্বব্যাপকতায় লইয়া যাইতেছে এবং সেই পথে মানুষের বিশেষ শক্তিকে বিশ্বশক্তির সহিত যোগযুক্ত করিতেছে। ভারতে ক্ৰমে ঋষিদের যুগ অর্থাৎ গৃহস্থ তাপসদের যুগ গেল ; ক্রমে বীেন্ধ সন্ন্যাসীর যুগ আসিল । ভারতবর্ষ যে মহাসত্য পাইয়াছিল তাহাকে জীবনের ব্যবহারের পথ হইতে তফাত করিয়া দিল। বলিল, সন্ন্যাসী হইলে তবেই মুক্তির সাধনা সম্ভবপর হয়। তার ফলে এ দেশে বিদ্যার সঙ্গে অবিদ্যার একটা আপস হইয়া গেছে; বিষয়বিভাগের মতো উভয়ের মহল-বিভাগ হইয়া মাঝখানে একটা দেয়াল উঠিল। সংসারে তাই ধর্মেকর্মে আচারে বিচারে যত সংকীর্ণতা যত স্থূলতা যত মুঢ়তাই থাক উচ্চতম সত্যের দিক হইতে তার প্রতিবাদ নাই, এমনকি, সমর্থন আছে। গাছতলায় বসিয়া জ্ঞানী বলিতেছে, "যে-মানুষ আপনাকে সর্বভূতের মধ্যে ও সর্বভূতকে আপনার মধ্যে এক করিয়া দেখিয়াছে সেই সত্যকে দেখিয়ছে, অমনি সংসায়ী ভক্তিতে গলিয়া তার ভিক্ষার বুলি ভরিয়া দিল । ও দিকে সংসারী তার দরদালনে বসিয়া বলিতেছে, ‘যে-বেটা সর্বভুতকে যতদূর সম্ভব। তফাতে রাখিয়া না চলিয়াছে তার ধোবানাপিত বন্ধ, আর জ্ঞানী আসিয়া তার মাথায় পায়ের ধূলা দিয়া আশীর্বাদ করিয়া গেল, “বাবা বীচিয়া থাকে। এইজন্যই এ দেশে কর্মসংসারে বিচ্ছিন্নতা জড়তা পদে পদে বাড়িয়া চলিল, কোথাও তাকে বাধা দিবার কিছু নাই। এইজন্যই শত শত বছর ধরিয়া কর্মসংসারে আমাদের এত অপমান, এত হার । যুরোপে ঠিক ইহার উলটা। যুরোপের সত্যসাধনার ক্ষেত্র কেবল জ্ঞানে নহে ব্যবহারে। সেখানে রাজ্য সমাজে যে-কোনো খুঁত দেখা যায় এই সত্যের আলোতে সকলে মিলিয়া তার বিচার, এই সত্যের সাহায্যে সকলে মিলিয়া তার সংশোধন । এইজন্য সেই সত্য যে-শক্তি যে-মুক্তি দিতেছে সমস্ত মানুষের তাঁহাতে অধিকার, তাহা সকল মানুষকে আশা দেয়, সাহস দেয়- তাহার বিকাশ তন্ত্ৰমন্ত্রের কুয়াশায় ঢাকা নয়, মুক্ত । আলোকে সকলের সামনে তাহা বাড়িয়া উঠিতেছে এবং সকলকেই বাড়াইয়া তুলিতেছে। এই যে কর্মসংসারে শত শত বছর ধরিয়া অপমানটা সহিলাম সেটা আমাদের কাছে দেখা দিয়াছে রাষ্ট্ৰীয় পরাধীনতার আকারে। যেখানে ব্যথা সেইখনেই হাত পড়ে। এইজন্যই যে-যুরোপীয় জাতি প্ৰভুত্ব পাইল তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকেই আমাদের সমস্ত মন গেল। আমরা আর সব কথা ভুলিয়া কেবলমাত্র এই কথাই বলিতেছি যে, ভারতের শাসনতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের ইচ্ছার যোগসাধন হোক- উপর হইতে যেমন-খুশি নিয়ম হানিবে। আর আমরা বিনা খুশিতে সে-নিয়ম মানিব এমনটা না হয়। কর্তৃত্বকে কঁধে চাপাইলেই বোঝা ইয়া ওঠে, ওটাকে এমন একটা চাকওয়ালা ঠেলাগাড়ির উপর নামানো হােক যেটাকে আমরাও নিজের হাতে ঠেলিতে পারি। আজকের দিনে এই প্রার্থনা পৃথিবীর সব দেশেই জাগিয়া উঠিয়াছে যে, বাহিরের কর্তার সম্পূর্ণ একতরফা শাসন হইতে মানুষ চুটি লাইবে। এই প্রার্থনায় আমরা যে যোগ দিয়াছিতাহাকালের ধর্মে-না যদি দিতাম, । যদি বলিতাম রাষ্ট্রব্যাপারে আমরা চিরকালই কর্তাভজা, সেটা আমাদের পক্ষে নিতান্ত লজ্জার কথা হইত। অন্তত একটা ফাটল দিয়াও সত্য আমাদের কাছে দেখা দিতেছে, এটাও শুভলক্ষণ । ܝ সত্য দেখা দিল বলিয়াই আজ এতটা জোর করিয়া বলিতেছি যে, দেশের যে আত্মাভিমানে আমাদের b8