পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

wav রবীন্দ্র-রচনাবলী মানিত তবে টাকা খরচ করিতই না, কিংবা নিজের জন্য করিত। সে কথা ঠিক, কিন্তু তার একটা মন্ত লাভ হইত এই যে, সেই খরচ-না-করাটাকে কিংবা নিজের জন্য খরচ করাটাকে সে ধর্মবলিয়া নিজেকে ভোলাইত। না, এই মোহের দাসত্ব হইতে তার মন মুক্ত থাকিিত । মনের এই মুক্তির অভাবেই দেশের শক্তি বাহিরে আসিতে পারিতেছে না। কেননা যাকে চােখ বুজিয়া চালানো অভ্যাস করানাে হইয়াছে, চোখ খুলিয়া চলিতে তার পা কঁপে, অনুগত দাসের মতো যে কেবল মানবের জন্যই প্রাণ দিতে শিখিয়ছে, আপনি প্ৰভু হইয়া স্বেচ্ছায় ন্যায়ধর্মের জন্য প্ৰাণ দেওয়া তার পক্ষে অসাধ্য। এইজন্যই আমাদের পাড়াগাঁয়ে অন্ন জল স্বাস্থ্য শিক্ষা আনন্দ সমস্ত আজ উটার মুখে। আত্মশক্তি না জাগাইতে পারিলে পল্লীবাসীর উদ্ধার নাই- এই কথা মনে করিয়া, নিজের কল্যাণ নিজে করিবার শক্তিকে একটা বিশেষ পাড়ায় জগাইবার চেষ্টা করিলাম। একদিন পাড়ায় আগুন লাগিল ; কাছে কোথাও এক ফোটা জল নাই; পাড়ার লোক দাড়াইয়া হায় হায় করিতেছে। আমি তাদের বলিলাম, নিজের মজুরি' দিয়া যদি তোমরা পাড়ায় একটা কুয়াে খুঁড়িয়া দাও আমি তার বাঁধাইবার খরচা দিব।” তারা ভাবিল, পুণ্য হইবে ঐ সেয়ানা লোকটার, আর তার মজুরি জোগাইব আমরা, এটা ফাঁকি। সে কুয়ো খোড়া হইল না, জলের কষ্ট রহিয়া গেল, আর আগুনের সেখানে বাধা নিয়ন্ত্রণ। এই যে আটল দুৰ্দশা, এর কারণ, গ্রামের যা-কিছু পূর্তকার্যতা এ পর্যন্ত পুণ্যের প্রলোভনে ঘটিয়াছে। তাই মানুষের সকল অভাবই পূরণ করিবার বরাত হয় বিধাতার পরে, নয় কোনাে আগন্তুকের উপর। পুণ্যের উমেদার যদি উপস্থিত না থাকে। তবে এরা জল না-খাইয়া মরিয়া গেলেও নিজের হাতে এক কোদাল মাটিও কাটিবে না। কেননা এরা এখনাে সেই বুড়ির কোল থেকে নামে নাই যে-বুড়ি এদের জাতিকুল ধৰ্মকৰ্ম ভালোমন্দ শোওয়াবসা সমস্তই বাহির হইতে বাধিয়া দিয়াছে। ইহাদের দােষ দিতে পারি না, কেননা বুড়ি এদের মনটাকেই আফিম খাওয়াইয়া ঘুম পাড়াইয়াছে। কিন্তু অবাক হইতে হয় যখন দেখি, এখনকার কালের শিক্ষিত যুবকেরা, এমনকি, কলেজের তরুণ ছাত্রেরাও এই বুড়িতন্ত্রের গুণ গাহিতেছেন। ভারতবর্ষাক সনাতন ধাত্রীর কাখে চড়িতে দেখিয়া ইহাদের ভারি গর্ব ; বলেন, ওটা বড়ো উচ্চজায়গা, ওখান হইতে পা মাটিতেই পড়ে না ; বলেন, ঐ কঁাখে থাকিয়াই আত্মকর্তৃত্বের রাজদণ্ড হাতে ধরিলে বড়ো শোভা হইবে। অথচ স্পষ্ট দেখি, দুঃখের পর দুঃখ, দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ ; যমলোকের যতগুলি চর আছে। সবগুলিই আমাদের ঘরে ঘরে বাসা লইল। বাঘে ডাকাতে তাড়া করিলেও যেমন আমাদের অস্ত্ৰ তুলিবার হুকুম নাই তেমনি এই অমঙ্গলগুলো লাফ দিয়া যখন ঘাড়ের উপর দাঁত বসাইতে আসে তখন দেখি সামাজিক বন্দুকের পাস নাই। ইহাদিগকে খেদাইবার অস্ত্ৰ জ্ঞানের অস্ত্ৰ, বিচারবুদ্ধির অস্ত্ৰ। বুড়ির শাসনের প্রতি র্যাদের ভক্তি অটল তঁরা বলেন, “ঐ অস্ত্রটা কি আমাদের একেবারে নাই ? আমরাও সায়াল শিখিব এবং যতটা পারি খাটাইব ।’ অস্ত্ৰ একেবারে নাই বলিলে অত্যুক্তি হয়। কিন্তু অস্ত্ৰ-পাসের আইনটা বিষম কড়া। অস্ত্ৰ ব্যবহার করিতে দিয়াও যতটা না-দিতে পারা যায় তারই উপর ষোলো-আনা বেঁক। ব্যবহারের গণ্ডি এতই, তার একটু এদিক-ওদিক হইলেই এত দুৰ্জয় কানমলা, সমস্ত গুরুপুরোহিত তাগাতাবিজ সংস্কৃত শ্লোক ও মেয়েলি মন্ত্র এত ভয়ে ভয়ে সাবধানে বঁাচাইয়া চলিতে হয় যে, ডাকাত পড়িলে ডাকাতের চেয়ে অনভ্যাসের বন্দুকটা লইয়াই ফাপরে পড়িতে হয় । যাই হােক, পায়ের বেড়িটা অক্ষয় হােক বলিয়াই যখন আশীৰ্বাদ করা হইল। তখন দয়ালু লোক এ কথাও বলিতে বাধ্য যে, মানুষদের কাধে করিয়া বেড়াইতে প্রস্তুত হও । যত রাজ্যের জাতের বেড়া, আচারের বেড় মেরামত করিয়া পাকা করাই যদি পুনরুজীবন হয়, যদি এমনি করিয়া জীবনের ক্ষেত্ৰকে বাধাগ্ৰস্ত ও বুদ্ধির ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করাইয়া আমাদের গৌরবের কথা হয় তবে সেইসঙ্গে এ কথাও বলিতে হয়, এই অক্ষমদের দুই বেলা লালন করিবার জন্য দল বাধো। কিন্তু দুই বিপরীত কুলকে একসঙ্গে বীচাইবার সাধ্য কোনো শক্তিমানেরই নাই। তুষার্তের ঘাড়াঘাট সমস্ত চুরমার করিবে, তার পরে চালুনি দিয়া জল আনিতে ঘন ঘন ঘাটে-ঘরে আনাগোনা, এ আবদার বিধাতার সহ্য হয় না। অনেকে বলেন, এ দেশে পদে পদে এত দুঃখদারিদ্র্য, তার মূল কারণ এখানকার সম্পূর্ণ শাসনভার পরজাতির উপর । কথাটাকে বিচার করিয়া দেখা দরকার ।