পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় Wedł সঁওতালরা কোথাও করছে চাষ, কোথাও চলেছে পথহীন প্ৰান্তরে আর্তস্বরে গোরুর গাড়ি, কিন্তু এই খোয়াইয়ের গহবরে জনপ্রাণী নেই। ছায়ায়-রৌদ্রে-বিচিত্র লাল কঁাকরের এই নিভৃত জগৎ, না দেয় ফল, না দেয়। ফুল, না উৎপন্ন করে ফসল, এখানে না আছে কোনো জীবজন্তুর বাসা ; এখানে কেবল দেখি কোনো আর্টিস্ট-বিধাতার বিনা কারণে একখানা যেমন-তেমন ছবি আঁকবার শশ্ন ; উপরে মেঘহীন নীল আকাশ রৌদ্রে পাণ্ডুর আর নীচে লাল কঁাকরের রঙ পড়েছে মোটা তুলিতে নানা রকমের বঁাকাচােরা বন্ধুর রেখায় ; সৃষ্টিকর্তার ছেলেমানুষ ছাড়া এর মধ্যে আর-কিছুই দেখা যায় না । বালকের খেলার সঙ্গেই এর রচনার ছন্দের মিল ; এর পাহাড়, এর নদী, এর জলাশয়, এর গুহাগহবর, সবই বালকের মনেরই পরিমাপে । এইখানে একলা আপন-মনে আমার বেলা কেটেছে অনেক দিন, কেউ আমার কাজের হিসাব চায় নি, কারও কাছে আমার সময়ের জবাবদিহি ছিল না । -- তখন শান্তিনিকেতনে আর-একটি রোমান্টিক অর্থাৎ কাহিনীরসের জিনিস ছিল। যে সর্দার ছিল এই বাগানের প্রহরী এক কালে সেই ছিল ডাকাতের দলের নায়ক । তখন সে বৃদ্ধ, দীর্ঘ তার দেহ, মাংসের বাহুল্য মাত্র নেই, শ্যামবর্ণ, তীক্ষ চোখের দৃষ্টি, লম্বা বীশের লাঠি হাতে, কণ্ঠস্বরটা ভাঙা ভাঙা গােছের। বােধ হয় সকলে জানেন, আজ শান্তিনিকেতনের যে অতি প্ৰাচীন যুগল ছাতিমগাছ মালতীলতায় আচ্ছন্ন, এক কালে মস্ত মাঠের মধ্যে ওই দুটি ছাড়া আর গাছ ছিল না । ঐ গাছতলা ছিল ডাকাতের আড্ডা। ছায়াপ্রত্যাশী। অনেক ক্লান্ত পথিক এই ছাতিমতলায় হয়। ধন, নয় প্রাণ, নয় দুইই হারিয়েছে সেই শিথিল রাষ্ট্রশাসনের কালে । এই সর্দার সেই ডাকাতিকাহিনীর শেষ পরিচ্ছেদের শেষ পরিশিষ্ট বলেই খ্যাত । বামাচারী তান্ত্রিক শাক্তের এই দেশে মা কালীর খপরে এ যে নররক্ত জোগায় নি তা আমি বিশ্বাস করি নে। আশ্রমের সম্পর্কে কোনো রক্তচক্ষু রক্ততিলকলাঞ্ছিত ভদ্রবংশের শাক্তকে জানতুম যিনি মহামাংসপ্ৰসাদ ভোগ করেছেন বলে জনশ্রুতি কানে এসেছে । 'একদা এই দুটিমাত্র ছাতিমগাছের ছায়া লক্ষ্য করে দূরপথযাত্রী পথিকেরা বিশ্রামের আশায় এখানে আসত। আমার পিতৃদেবও রায়পুরের ভুবনসিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণ সেরে পালকি করে যখন একদিন ফিরছিলেন তখন মাঠের মাঝখানের এই দুটি গাছের আহবান তীর মনে এসে পৌঁচেছিল । এইখানে শান্তির প্রত্যাশায় রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে এই জমি তিনি দান গ্রহণ করেছিলেন । একখানি একতলা বাড়ি পত্তন করে এবং রুক্ষ রিক্তভূমিতে অনেকগুলি গাছ রোপণ করে সাধনার জন্য এখানে তিনি মাঝে মাঝে আশ্রয় গ্রহণ করতেন । সেই সময়ে প্রায়ই তার ছিল হিমালয়ে নির্জনবাস । যখন রেল লাইন স্থাপিত হল, তখন বোলপুর স্টেশন ছিল পশ্চিমে যাবার পথে, অন্য লাইন তখন ছিল না । তাই হিমালয়ে যাবার মুখে বোলপুরে পিতা তার প্রথম যাত্রাভঙ্গ করতেন । আমি যে-বারে তীর সঙ্গে এলুম, সে-বারেও ডালহৌসি পাহাড়ে যাবার পথে তিনি বোলপুরে অবতরণ করেন । আমার মনে পড়ে, সকালবেলায় সূর্য ওঠবার পূর্বে তিনি ধ্যানে বসতেন অসমাপ্ত জলশূন্য পুষ্করিণীর দক্ষিণ পাড়ির উপরে । সূর্যস্ত কালে তার ধ্যানের আসন ছিল ছাতিমতলায় । এখন ছাতিমগাছ বেষ্টন করে অনেক গাছপালা হয়েছে, তখন তার কিছুই ছিল না— সামনে অবারিত মাঠ পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত ছিল একটানা । আমার পরে । একটি বিশেষ কাজের ভার ছিল । ভগবদগীতা গ্রন্থে কতকগুলি শ্লোক তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, আমি প্রতিদিন কিছু কিছু তাই কপি করে দিতুম তাকে । তার পরে সন্ধ্যাবেলা খোলা আকাশের নীচে বসে সৌরজগতের গ্রহমণ্ডলের বিবরণ বলতেন আমাকে, আমি শুনতুম একান্ত ঔৎসুক্যের সঙ্গে । মনে পড়ে, আমি তীর মুখের সেই জ্যোতিষের ব্যাখ্যা লিখে তাকে শুনিয়েছিলুম। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে শান্তিনিকেতনের কোন ছবি আমার মনের মধ্যে ২২ 'আশ্রমের রক্ষী ছিল বৃদ্ধ দ্বারা সর্দার, মালী ছিল হরিশ, দ্বারীর ছেলে।”— আশ্রমের রূপ ও বিকাশ