পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬৯৮ রবীন্দ্র-রচনাবলী “ঘরের পড়া পরিচ্ছেদের উপসংহারে প্রথম পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গিয়াছে : “এ কথা বলা বাহুল্য, তখন বিদ্যাপতি অথবা অন্যান্য বৈষ্ণব কবির পদ অবাধে পড়িবার উপযুক্ত বয়স আমার হয় নাই, কিন্তু আমি সেগুলি তন্ন তন্ন করিয়া পড়িয়ছিলাম। ইহাতে আমার বালককালের কল্পনাকে নিঃসন্দেহই কিছু আবিল করিয়াছিল। কিন্তু সে আবিলতা এক সময়ে আপনিই কাটিয়া গেল, কিন্তু পদগুলির গভীর সৌন্দৰ্য আমার অন্তঃকরণের সহিত জড়িত হইয়া গেছে । ‘কেবল বৈষ্ণবপদাবলী নহে, তখন বাংলা সাহিত্যে যে-কোনো বই বাহির হইত। আমার লুব্ধ হস্ত এড়াইতে পারিত না । মনে আছে, দীনবন্ধু মিত্রের ‘জামাইবারিক বইখানি আমার কোনো সতর্ক আত্মীয়ার হাত হইতে সংগ্ৰহ করিয়া পড়িতে আমাকে নানাপ্রকার কৌশল করিতে হইয়াছিল। এই সকল বই পড়িয়া জ্ঞানের দিক হইতে আমার যে অকালপরিণতি হইয়াছিল বাংলা গ্ৰাম্যভাষায় তাহাকে বলে জ্যাঠামি— প্রথম বৎসরের ভারতীতে প্রকাশিত আমার বাল্যরচনা "করুণা’-নামক গল্প তাহার নমুনা । কিন্তু এই অকলোচিত জ্ঞানগুলি মস্তিষ্কের উপরিভাগেই ছিল, তাহারা হৃদয়কে স্পর্শ করিতে পারে নাই । বরঞ্চ এখনকার কালের ছেলেদের সঙ্গে তুলনা করিলে দেখিতে পাই, যথার্থভাবে পরিণত হইয়া উঠিতে আমার সুদীর্ঘকাল লাগিয়াছিল। আমার বালকবুদ্ধি আমাকে অনেক দিন ত্যাগ করে নাই- আমি অধিক বয়সেও নানা বিষয়ে অদ্ভুত রকম কঁাচা ছিলাম। একটা-কিছু জ্ঞানে জােনা এবং তাহাকে আত্মসাৎ করার মধ্যে অনেক প্রভেদ আছে— আমার বালককালের সংসারজ্ঞান তাহার একটা দৃষ্টান্ত । এবং সেই দৃষ্টান্ত হইতেই আজ আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারি, ইংরাজি হইতে আমরা যে-সকল শিক্ষা খুব পাইয়াছি বলিয়া চারি দিকে ফলাইয়া বেড়াইতেছি, যদি কালক্রমে সেই শিক্ষা যথার্থভাবে আমাদের প্রকৃতিগত হয় তখন বুঝিতে পারিব— আমাদের পূর্বের অবস্থা কিরূপ অদ্ভুত অসত্য এবং হাস্যকর এবং তখন আমাদের আস্ফালনও যথেষ্ট শান্ত হইয়া আসিবে । ‘এই উপলক্ষে প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা বলিয়া লইব । যখন আমার বয়স নিতান্তই অল্প ছিল এবং দূষিতবুদ্ধি আমার জ্ঞানকেও স্পর্শ করে নাই, এমন সময় একদিন বড়দাদা তাহার ঘরে ডাকিয়া ইন্দ্ৰিয়সংযম ও ব্ৰহ্মচৰ্যপালন সম্বন্ধে আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন । তাহার উপদেশ আমার মনে এমনি গাথিয়া গিয়াছিল যে, ব্ৰহ্মচর্য হইতে স্থলন আমার কাছে বিভীষিকাস্বরূপ হইয়াছিল । বোধ করি, এইজন্য বাল্যবয়সে অনেক সময়ে আমার জ্ঞান ও কল্পনা যখন বিপদের পথ দিয়া গেছে তখন আমার সংকোচপরায়ণ আচরণ নিজেকে ভ্ৰষ্টতা হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছে।” ‘বাড়ির আবহাওয়া’ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত 'নবনাটক অভিনয় সম্পর্কে পূর্ণতর পরিচয় এ স্থলে সংকলিত छ्ठ्ल : ‘নাট্যশালা সমিতির’২৭ অনুরোধে রামনারায়ণ তর্করত্ন অল্প সময়ের মধ্যেই নব নাটক’-নামক নূতন নাটক প্রণয়ন করিলেন । ১২৭৩ সনের ২৩শে বৈশাখ এক প্রকাশ্য সভা আহুত হইল এবং কলিকাতার সম্রান্ত ব্যক্তিগণের সমক্ষে নাটকখানি আদ্যোপান্ত পঠিত হইল । সভাপতি প্যারীচাঁদ করিলেন । কেবল ইহাই নহে, গণেন্দ্রনাথ গ্ৰন্থখানির সহস্ৰ খণ্ড মুদ্রণের সমস্ত ব্যয় এবং গ্রন্থস্বত্বও নাট্যকারকে প্ৰদান করিলেন ।” --জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পৃ. ১২ ২৭। কৃষ্ণবিহারী সেন, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়চন্দ্ৰ চৌধুরী এবং জ্যোতিবাবুর ভগিনীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায়, এই পাঁচজনকে লইয়া গঠিত নাট্যসমিতি ৷- জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ. ৯৬