পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় । Գ ՕԳ ইংলন্ডে যাইতে অনুমতি দিলাম। তুমি সৎপথে থাকিয়া কৃতকার্য হইয়া দেশেতে যথাসময়ে ফিরিয়া আসিবে, এই আশা অবলম্বন করিয়া থাকিলাম । সত্যেন্দ্ৰ পাঠাবস্থাতে যতদিন ইংলন্ডে ছিলেন ততদিন- টাকা করিয়া প্রতি মাসে পাইতেন । তোমার জন্য মাসে. টাকা নির্ধারিত করিয়া দিলাম । ইহাতে যত পাউন্ড হয় তাহাতেই তথাকার তোমার যাবদীয় খরচ নির্বাহ করিয়া লইবে । বারে প্রবেশের কী এবং বার্ষিক চেম্বার কী আবশ্যকমতে পাইবে । তুমি এবার ইংলন্ডে গেলে প্ৰতিমাসে ন্যানকল্পে একখানা করিয়া আমাকে পত্র লিখিবে । তোমার থাকার জন্য ও পড়ার জন্য সেখানে যাইয়া যেমন যেমন ব্যবস্থা করিবে তাহার বিবরণ আমাকে লিখিবে । গতবারে সত্যেন্দ্ৰ তোমার সঙ্গে ছিলেন, এবারে মনে করিবে আমি তোমার সঙ্গে আছি । ইতি ৮ ভাদ্রা ৫১ ৷ * —পত্রসংখ্যা ১৩৬, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী, প্ৰিয়নাথ শাস্ত্রী -প্ৰকাশিত ‘গঙ্গাতীর পরিচ্ছেদের সূচনাংশের পাঠ প্রথম পাণ্ডুলিপিতে এরূপ দেখা যায় : ; আরও তো অনেক জায়গায় ঘুরিয়াছি- ভালো জিনিস, প্রশংসার জিনিস অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু সেখানে তো আমার এই মা'র মতো আমাকে কেহ অন্ন পরিবেশন করে নাই। আমার কড়ি যে হাটে চলে না। সেখানে কেবল সকল জিনিসে চোখ বুলাইয়া ঘুরিয়া দিনযাপন করিয়া কী করিব ! যে বিলাতে যাইতেছিলাম সেখানকার জীবনের উদ্দীপনাকে কোনোমতেই আমার হৃদয় গ্রহণ করিতে পারে নাই । আমি আর-একবার বিলাতে যাইবার সময় পত্রে লিখিয়াছিলাম

  • “নিচেকার ডেকে বিদ্যুতের প্রখর আলোক, আমোদপ্রমোদের উচ্ছাস, মেলামেশার ধুম, গানবাজনা এবং কখনো কখনো ঘূণী:নৃত্যের উৎকট উন্মত্ততা । এদিকে আকাশের পূর্বপ্রান্তে ধীরে ধীরে চন্দ্র উঠছে, তারাগুলি ক্রমে স্নান হয়ে আসছে, সমুদ্র প্রশান্ত ও বাতাস মৃদু হয়ে এসেছে ; অপর সমুদ্রতল থেকে অসীম নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত এক অখণ্ড নিস্তব্ধতা, এক অনির্বচনীয় শান্তি নীরব উপাসনার মতো ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে । আমার মনে হতে লাগল, যথার্থ সুখ কাকে বলে এরা ঠিক জানে না । সুখকে চাবকে চাবকে যতক্ষণ মত্ততার সীমায় না নিয়ে যেতে পারে ততক্ষণ এদের যথেষ্ট হয় না। প্রচণ্ড জীবন ওদের যেন অভিশাপের মতো নিশিদিন তাড়া করেছে ; ওরা একটা মস্ত লোহার রেলগাড়ির মতো চোখ রাঙিয়ে, পৃথিবী কঁাপিয়ে, হাঁপিয়ে, ধুইয়ে, জ্বলে, ছুটে প্রকৃতির দুই ধারের সৌন্দর্যের মাঝখান দিয়ে হুস করে বেরিয়ে চলে যায় । কর্ম বলে একটা জিনিস আছে বটে কিন্তু তারই কাছে আমাদের মানবজীবনের সমস্ত স্বাধীনতা বিকিয়ে দেবার জন্যেই আমরা জন্মগ্রহণ করি নি- সৌন্দৰ্য আছে, আমাদের অন্তঃকরণ আছে, সে দুটাে খুব উচু জিনিস।”

“আমি বৈলাতিক কর্মশীলতার বিরুদ্ধে উপদেশ দিতেছি না । আমি নিজের কথা বলিতেছি । আমার পক্ষে বাংলাদেশের এই আকাশভরা আলো, এই দক্ষিণের বাতাস, এই গঙ্গার প্রবাহ, এই রাজকীয় আলস্য, এই আকাশের নীল ও পৃথিবীর সবুজের মাঝখানকার দিগন্তপ্রসারিত উদার অবকাশের মধ্যে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। তৃষ্ণার জল ও ক্ষুধার অন্নের মতোই আবশ্যক ছিল। যদিও খুব বেশিদিনের কথা নহে তবু ইতিমধ্যে সময়ের অনেক পরিবর্তন হইয়া গেছে। আমাদের তরুচ্ছায়াপ্ৰচ্ছন্ন গঙ্গাতটের নীড়গুলির মধ্যে কলকারখানা উধৰ্ব্বফণা সাপের মতো প্ৰকাশ করিয়া র্সো সো শব্দে কালো নিশ্বাস যুঁসিতেছে। এখন খর মধ্যাহ্নে আমাদের মনের মধ্যেও বাংলাদেশের স্নিগ্ধচ্ছায়া খর্বতম হইয়া আসিয়াছে- এখন দেশে কোথাও অবসর নাই। হয়তো সে ভালোই- কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভালো এমন কথাও জোর করিয়া বলিবার সময় হয় নাই । “বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিবার পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে আর-একখানি পুরাতন চিঠি হইতে উদধূত করিয়া দিই ৩৭ ৫১ ব্ৰাহ্ম সংবৎ বাংলা ১২৩৬ সাল হইতে গণনারম্ভ ।