পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় SS পুষ্পাঞ্জলি সূর্যদেব, তুমি কোন দেশ অন্ধকার করিয়া এখানে উদিত হইলে ? কোনখানে সন্ধ্যা হইল ? এ সন্ধ্যার মেঘের ছায়া অতি কোমল লাবণ্যে গাছগুলির উপরে পড়িয়াছে ! এখানে আমাদিগকে জাগাইতে আসিয়াছ, সেখানে কাহাদিগকে ঘুম পাড়াইয়া আসিলে ? সেখানকার বালিকারা ঘরে দীপ জ্বালাইয়া ঘরের দুয়ারটি খুলিয়া সন্ধ্যালোকে দাড়াইয়া কি তাহাদের পিতার জন্য অপেক্ষা করিতেছে ? সেখানে তো মা আছে- তাহারা কি তাহাদের ছােটাে ছােটাে শিশুগুলিকে চাদের আলোতে শুয়াইয়া, মুখের পানে চাহিয়া চুমো খাইয়া, বুকে চাপিয়া ধরিয়া ঘুম পাড়াইতেছে ? কতশত সেখানে কুটির গাছপালার মধ্যে, নদীর ধারে, পর্বতের উপত্যকায, মাঠের পাশে, অরণ্যের প্রান্তে আপনার আপনার স্নেহ প্ৰেম সুখ দুঃখ বুকের মধ্যে লইয়া সন্ধ্যাচ্ছায়ায় বিশ্রাম ভোগ করিতেছে ! সেখানে আমাদের কোন অজ্ঞাত একটি পাখি এই সময়ে গাছের ডালে বসিয়া ডাকে ; সেখানকার লোকের প্রাণের সুখদুঃখের সহিত প্রতি সন্ধাবেলায় এই পাখির গান মিশিয়া যায়। তাঁহাদের দেশে যে-সকল কবিরা বহুকাল পূর্বে বাস করিত, যাহারা আর নাই, লোকে যাহাদের গান জানে কিন্তু নাম জানে না, তাহারাও কোন সন্ধ্যাবেলায় কোন-এক নদীর ধারে ঘাসের পরে শুইয়া এই পাখির গান শুনিত ও গান গাহিত ! সে হয়তো আজ বহুদিনের কথা--- কিন্তু তখনকার প্রেমিকেরাও তো সহসা এই পাখির স্বর শুনিয়া পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়াছিল, বিরহীরা এই পাখির গান শুনিয়া সন্ধ্যাবেলায় নিশ্বাস ফেলিয়াছিল। ! কিন্তু তাহারা তাহাদের সে-সমস্ত সুখদুঃখ লইয়া একেবারে চলিয়া গিয়াছে। তাহারাও যখন জীবনের খেলা খেলিত, ঠিক আমাদের মতো করিয়াই খেলিত, এমনি করিয়াই কাদিতঁ ; তাহারা ছায়া ছিল না, মায়া ছিল না, কাহিনী ছিল না । তাহাদের গায়েও বাতাস ঠিক এমনি জীবন্ত ভাবেই লাগিত— তাহারা তাহাদের বাগান হইতে ফুল তুলিত ; তাহারা এক কালে বালক বালিকা ছিল— যখন মা-বাপের কোলে বসিয়া হাসিত তখন মনে হইত না তাহারাও বড়ো হইবে । কিন্তু তবুও তাহারা আজিকার এই চারি দিকের জীবময় লোকারণ্যের মধ্যে কেমন করিয়া একেবারে “নাই” হইয়া গেল ! বাগানে এই-যে বহুবৃদ্ধ বকুলগাছটি দেখিতেছি- একদিন কোন সকালবেলায় কী সাধ করিয়া কে একজন ইহা রোপণ করিতেছিল— সে জানিত সে ফুল তুলিবে, সে মালা গাঁথিবে ; সেই মানুষটি শুধু নাই, সেই সাধটি শুধু নাই, কেবল ফুল ফুটিতেছে আর ঝরিয়া পড়িতেছে। আমি যখন ফুল সংগ্ৰহ করিতেছি তখন কি জানি কাহার আশার ধন কুড়াইতেছি, কাহার যত্নের ধনে মালা গাঁথিতেছি ! হায় হায়, সে যদি আসিয়া দেখে, সে যাহাদিগকে যত্ন করিত, সে যাহাদিগকে রাখিয়া গিয়াছে, তাহারা আর তাহার নাম করে না, তাহারা আর তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেয় না— যেন তাহারা। আপনিই হইয়াছে, আপনিই আছে, এমনি ভান করে- যেন তাহাদের সহিত কাহারও যোগ ছিল না । и কিন্তু এই বুঝি এ জগতের নিয়ম । আর এ নিয়মের অর্থও বুঝি আছে! যতদিন কাজ করিবে: ততদিন প্রকৃতি তোমাকে মাথায় করিয়া রাখিবে । ততদিন ফুল তোমার জন্যই ফুটে, আকাশের হয় । কিন্তু যেই তোমা দ্বারা আর কোনো কাজ পাওয়া যায় না, যেই তুমি মৃত হইলে, অমনি সে তাড়াতাড়ি তোমাকে সরাইয়া ফেলে— তোমাকে চােখের আড়াল করিয়া দেয়- তোমাকে এই জগৎ-দৃশ্যের নেপথ্যে দূর করিয়া দেয়। খরতর কালস্রোতের মধ্যে তোমাকে খড়কুটার মতো ঝাটাইয়া ফেলে, তুমি হুহু করিয়া ভাসিয়া যাও, দিনদুই বাদে তোমার আর একেবারে নাগাল