পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় १२७ বহিরাবরণের মধ্য হইতে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহার ভিতরের কথাটি যাহা এতদিন সহস্ৰ চেষ্টা করিয়াও আলোকাভাবে আপনাকে প্রকাশ করিতে পারিয়া উঠিতেছিল না, এইবার তাহার সে চেষ্টা বাঞ্ছানুরূপ সাফল্য লাভ করিবে তাহার অরুণোদয় দেখা দিয়াছে; তবে যে, চতুর্দিকে কর্কশ। কী কী ধ্বনি হইতেছে- রজনী-প্ৰভাতের সমসমকালে তাহা হইবারই কথা। এতদিনের ধন্তাধস্তির পরে ভারতে প্রকৃত ইতিহাসের এই যে একটা সম্ভবমতো পাকা রকমের গোড়াপত্তন হইল, ইহা বঙ্গ-সরস্বতীর ভক্ত সন্তানদিগের কত-না আনন্দের বিষয় । গোড়াপত্তন হইয়াছে যেরূপ সুন্দর, তাহার উপরে তদনুরূপ ভিত গাথিয়া তুলিতে হইলে আরো নানাপ্রকার ইষ্টক প্রস্তর এবং মালমশলার জোগাড় করা আবশ্যক, তা ছাড়া পুরাতন ইতিহাস-ভারতীর নূতন দেবালয়ের নির্মাণকার্যে বাছা-বাছা কারিকরদিগের সমবেত চেষ্টা কেন্দ্রীভূত হওয়া আবশ্যক । রবীন্দ্রনাথের নূতন প্ৰবন্ধটির সম্বন্ধে একটি প্রশ্ন আপাতত যাহা আমার মনে উখিত হইতেছে তাহা সংক্ষেপে এই ; মহাদেবের আদিম পীঠস্থান দক্ষিণ অঞ্চলে কি উত্তর অঞ্চলে ? রবীন্দ্রনাথের লেখার আভাসে আমার এইরূপ মনে হয় যে, তাহার মতে মহাদেবের আদিম পীঠস্থান দক্ষিণ অঞ্চলে । তিনি যাহা আঁচিয়াছেন তাহা একেবারেই অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিবার কথা নহে, যেহেতু বাস্তবিকই রক্ষসাদি ক্রুর জাতিদিগের মধ্যে বিষ্ণুর স্নিগ্ধমূর্তি উপাসা দেবতার আদর্শ পদবীতে স্থান পাইবার অনুপযুক্ত । দুৰ্দান্ত রাক্ষস জাতিদিগের মনোরাজ্যের সিংহাসন শিবের রুদ্রমূর্তিরই উপযুক্ত অধিষ্ঠান-মঞ্চ । কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও আমরা দেখিতে পাই যে, একদিক যেমন রক্ষঃ আর-একদিকে তেমনি যক্ষ । প্ৰাচীন ভারতের দক্ষিণ অঞ্চল যেমন রক্ষদিগের দলবলের প্রধান সংগমস্থান (headquarters) ছিল— উত্তর অঞ্চল তেমনি যক্ষদিগের দলবলের প্রধান সংগমস্থান ছিল । ভারতবষীয় আৰ্যদিগের চক্ষে দক্ষিণের দ্রাবিড়াদি জাতিরা যেমন রাক্ষস-বানরাদি মূর্তি ধারণ করিয়াছিল, উত্তরের মোগলাদি জাতিরা তেমনি যক্ষকিন্নরাদি মূর্তি ধারণ করিয়াছিল— ইহা দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। বিকটাকার বিষয়ের দক্ষিণের রক্ষ এবং উত্তরের যক্ষের মধ্যে যেমন মিল আছে, কিন্তুতকিমাকার বিষয়ে তেমনি দক্ষিণের বানর এবং উত্তরের কিন্নরের সঙ্গে মিল আছে । এখন কথা হইতেছে এই যে, যক্ষদিগের রাজধানীতে কুবেরপুরীতে মহাদেবের অধিষ্ঠানের কথা কাব্যপুরাণাদি শাস্ত্রে ভূয়োভূয় উল্লিখিত হইয়াছে। তা ছাড়া কৈলাসশিখর মহাদেবের প্রধান পীঠস্থান । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পাঠে একটি বিষয়ে আমার চক্ষু ফুটিয়াছে ; সে-বিষয়টি এই যে, জনক রাজা যে কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞানী ছিলেন তাহা নহে, সেইসঙ্গে তিনি ভারতে কৃষিকাৰ্য প্রবর্তনের প্রধান নেতা ছিলেন ; আর র্তাহার গুরু ছিলেন বিশ্বামিত্র। পক্ষান্তরে দেখিতে পাই যে, হিমালয় প্রদেশের কিরাত জাতিরা ব্যাধবৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবিকা-নির্বাহ করিত— তাহারা কৃষিকার্যের ধারই ধারিত না । কিরাত জাতি মােগল এবং তাতারদিগের সহােদর জাতি ইহা বলা । বাহুল্য । এটাও দেখিতেছি যে, হিমালয়ের উপত্যকায় মহাদেব অর্জুনকে কিরাতবেশে দেখা দিয়াছিলেন । মহাদেব কিরাতদিগের দলে মিশিয়া কিরাত হইয়াছিলেন । মহাদেব পশুহন্তাও বটেন, পশুপতিও বটেন । মহাদেব যে অংশে কিরাতদিগের ইষ্টদেবতা ছিলেন, সেই অংশে তিনি পশুহন্তা ; আর, যে অংশে তিনি খাস মোগলদিগের ইষ্টদেবতা ছিলেন, সেই অংশে তিনি পশুপতি । পুরাকালের মোগল এবং তাতার জাতিরা জীবিকালাভের একমাত্র উপায় জানিত পশুপালন, তা বৈ, কৃষিকার্যের কি অক্ষরও তাহারা জানিত না— ইহা সকলেরই জানা কথা । তবেই হইতেছে, মোগল এবং তাতার জাতিরা-সংক্ষেপে যক্ষেরা- একপ্রকার পশুপতির দল ছিল ; সুতরাং পশুপতি মহাদেব বিশিষ্টরূপে তাহাদেরই দেবতা হওয়া উচিত ; আর পুরাণাদিকে যদি শাস্ত্ৰ বলিয়া মানিতে হয়, তবে ছিলেনও তিনি তাই।। যক্ষরাজ কুবেরের রূপ ছিল