পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় ԳՀ@ না, এ কথা বিচার করিবার অধিকার আদি ব্ৰাহ্মসমাজের কাহারও নাই। উন্নতিশীল ব্ৰাহ্মগণ হিন্দুত্বের সংকীর্ণ গণ্ডী অনেককাল অতিক্রম করিয়াছেন ।** পরস্পরের উন্নতির তারতম্যসম্বন্ধে আমরা কোনো কথাই কইব না, কারণ ইহা আমাদের আলোচ্য বিষয় নহে। কিন্তু সমগ্ৰ হিন্দুসমাজের পক্ষে যাহা অন্যায় তাহা যে ব্ৰাহ্মসমাজের পক্ষেও অন্যায় অন্তত এ কথাটা আমাদিগকে কর্তব্যের অনুরোধে বলিতে হইবে । নিশ্চয়ই আমাদের অনেক কুসংস্কার আছে। যেমন যেমন তাহা বুঝিতে পারিব তেমনি তাহার বন্ধন কাটাইয়া উঠিব এইরূপ আশা করি।- কিন্তু আমাদের এরূপ সংস্কার আদীে নাই যে, বিচার করিয়া সত্য নির্ণয় করিবার অধিকার কেবল কোনো বিশেষ উপাধি দ্বারা চিহ্নিত সমাজের লোকেরই আছে। অন্য সমাজের লোকের নাই । যদিীচ আমি আদি ব্ৰাহ্মসমাজের সভ্য তথাপি ঈশ্বর আমার চিন্তা করিবার শক্তি সম্পূর্ণ অপহরণ করেন নাই ; এবং কে হিন্দু ও কে হিন্দু নয় ইহা আমার পক্ষে বিচার করিবার অধিকার যদিচ উন্নতিশীল সম্পাদক মহাশয় কড়িয়া লইতে চান তথাপি মনুষ্যত্বের সকল মহৎ অধিকারই আমরা যাহার কাছ হইতে পাইয়াছি তিনি এ সম্বন্ধে আমাদের কাহাকেও কোনো বাধা দিয়াছেন বলিয়া আমরা আদি ব্ৰাহ্মসমাজের লোকেরা বিশ্বাস করি।” না । p উপবীতচিহ্নের দ্বারা সমাজে অধিকারভেদ নির্দিষ্ট হয় বলিয়া যাহারা উপবীতধারণকে নিন্দা করেন তাহারা কি এ কথা চিন্তা করিবেন না যে, অদৃশ্য উপবীত দৃশ্য উপবীতের চেয়ে অনেকগুণে দৃঢ় ? “উন্নতিশীল ব্ৰাহ্ম’ নামের পৈতাটা উচ্চ করিয়া তুলিয়া ধরিয়া তত্ত্বকৌমুদীর সম্পাদক মহাশয় যে জাত্যভিমান, যে কীেলীন্যগর্ব প্ৰকাশ করিয়াছেন, জিজ্ঞাসা করি, তাহা কি সর্বপ্রকার কুসংস্কারবর্জিত ? উন্নতিশীল ব্ৰাহ্মগণ কেবলমাত্র উন্নতিশীলতার বেগে হিন্দুত্বের সংকীর্ণ গণ্ডী অনেক কাল হইল কাটাইয়াছেন বলিয়া সম্পাদক মহাশয় গৌরব প্রকাশ করিয়াছেন । কিন্তু যে গণ্ডী আমাদের স্বরচিত ও কৃত্রিম নহে তােহা আমরা কাটাইতে পারি না । যেমন আমার একটা দেহের গণ্ডী আছে । এই গণ্ডীকে আশ্রয় করিয়া আমি একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়াছি ; এই ঐ তন্ত্র্য যদি আমার উন্নতির প্রতিকূল ও আমার অপরাধ বলিয়া গণ্য হয় তবে বিশ্বের সহিত একাকার হইবার চেষ্টায় পঞ্চােত্বলাভ ছাড়া আমার অন্য কোনো গতি থাকে না । গণ্ডীর পরে গণ্ডী, চক্রের পর চক্ৰ কাটিয়া বিধাতা এই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন । পৃথিবীর গন্তী পৃথিবীর, সূর্যের গণ্ডী সূর্যের, তৃণের গণ্ডী তৃণের, মানুষের গণ্ডী মানুষের । স্বাভাবিক গণ্ডীর বিরুদ্ধে লড়াই করাই যে উন্নতিশীলতার লক্ষণ এ কথা মনে করি না । আবার আমাদের স্বরচিত গণ্ডীও আছে। কেননা, বিধাতার সৃষ্টিকার্যেও যেমন মানুষের সৃষ্টিকাৰ্যেও তেমনি— গন্তী দিয়া দিয়াই গড়িয়া তুলিতে হয়। মানুষের ঘরবাড়ি একটা গণ্ডী, তাহার পরিবার একটা গণ্ডী, তাহার ব্যবসায় একটা গণ্ডী । প্রত্যেক গণ্ডীর মধ্যে বিশিষ্টতা আছে, সেই বিশিষ্টতার দ্বারা মানুষ আপন ঘরে আপনি পরিবারে আপনি ব্যবসায়ে স্বতন্ত্র। এমন-কি, ” সামান্য ছাতাজুতা ঘটিবাটিও সরকারী নহে, এবং কেহ তাহাকে সরকারী করিবার চেষ্টা করিলেই থানায় খবর দিতে হয় । তাই যদি হইল। তবে সর্বজনীনতা বলিয়া একটা পদার্থ কি একেবারেই আকাশকুসুম ? যদি সকলপ্রকার গণ্ডীকে, সকলপ্রকার বিশিষ্টতাকে একেবারে অস্বীকার করাকেই সর্বজনীনতা বলে তবে সর্বজনীনতা বস্তুতই আকাশকুসুম সন্দেহ নাই। ভাইকে মানি না। কিন্তু ভ্ৰাতৃভাবকে মানি, এ কথাটাও যেমন তেমনি সর্বজনকে বিশেষ বলিয়া মানি না একটা নির্বিশেষ সর্বজনীনতাকে মানি ইহাও সেইরূপ মাথা-নেই-তাির-মাথা-ব্যথা। প্রত্যেকের বিশিষ্টতা আছে বলিয়াই সেই অগণ্য ৪৫ ‘আদি সমাজ ও উন্নতিশীল ব্ৰাহ্মসমাজ, তত্ত্বকৌমুদী, ১ বৈশাখ ১৩১৯