পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় १२१ সত্যকে তাহারা দেখান, ইহাই তাঁহাদের ব্ৰত । দুৰ্গতির মধ্যে যে সমাজ উপনীত হইয়াছে তাহাকে তাহারা ত্যাগ করেন না, কারণ তঁহাদের এই বিশ্বাস অটল যে দুৰ্গতি কখনােই নিত্য হইতে পারে না এবং যিনি পরমাগতিতিনি দুৰ্গতির মধ্যেই আপনাকে একদাপূর্ণতমরূপে প্রকাশকরেন। বস্তুত যথার্থ প্রেমের সাধনা, শক্তির সাধনা, সেইখানেই সেই দুর্যোগে সেই দুদিনে। আমাদের আত্মাভিমান সেখান হইতে দূরে যাইতে চায়, আমাদের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা তাহার প্রতি ঘূণা প্রকাশ করিয়া বিমুখ হইয়া থাকে, কিন্তু সেই ঘূণাই বিশ্বজনীনতার লক্ষণ নহে- কিন্তু যে দুৰ্গতিগ্রস্ত তাহাকেই আপনি বলিয়া স্বীকার করার মধ্যেই যথার্থ সর্বজনীনতা আছে। কারণ, সর্বজনীনতা কেবল একটা বস্তুবিহীন বাক্য মাত্র নহে, তাহা অহংকৃত আত্মপরিচয়ের একটা স্বরচিত উপাধি মাত্র নহে, তাহা প্রেমের জিনিস, এইজন্যই তাহা সত্য । সেই প্ৰেম সকলের চেয়ে নীচের মধ্যে আপনাকে বদ্ধ করিয়াও সকলের চেয়ে উচ্চে আপনার স্থান লাভ করিয়া থাকে ; সীমার মধ্যে বাস করিয়াও প্রতি মুহূর্তে সেই সীমাকে অতিক্রম করিয়া বিরাজ করে। ব্ৰাহ্মধর্ম হিন্দু-ইতিহাসের একটি বিকাশ, এই কথা আমরা বলিয়াছি। অর্থাৎ ব্ৰাহ্মধর্ম যতবড়োই সর্বজনীন ধর্মী হউক-না, বিধাতার সৃষ্টির নিয়ম তাহাকেও মানিতে হয়, নতুবা তাহা সত্যই হইতে পারে না । অতএব বিশেষ দেশে ও বিশেষ কালে তাহার উদয় হইয়াছে ব্ৰাহ্মধর্মের এই ঐতিহাসিক বন্ধন টুকু স্বীকার করিতে লজ্জা বা ক্ষোভের কোনো কারণ থাকিতে পারে না । যদি ইতিহাসকে মানি, যদি হিন্দু-ইতিহাসের মধ্যে ব্ৰাহ্মধর্মের প্রকাশরাপ ঘটনাকেই একেবারে অস্বীকার করিয়া না বসি তবে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটার সুস্পষ্ট অর্থই এই যে, হিন্দুর প্রকৃতির মধ্যে ও অবস্থার মধ্যে এমন কতকগুলি সমাবেশ আছে যাহাতে এই ধর্ম এইপ্ৰকার রূপ লইয়া এইখানেই ব্যক্তি হইতে পারিয়াছে । হিন্দু-ইতিহাসের মধ্যে এই যে ব্ৰাহ্মধর্মের প্রকাশ, ইহার কারণরূপে নানা শক্তির খেলা থাকিতে পারে । হয়তো বিদেশের আঘাত তাহার মধ্যে একটা কারণ। অর্ধরাত্রে ভূমিকম্পে আমাকে জাগাইয়াছিল, তাই বলিয়া জাগরণটা ভূমিকম্পের নহে সেটা আমারই জাগরণ । যদি ইহাই প্রকৃত সত্য হয় যে, কোরান পুরাণ বাইবেল বৌদ্ধশাস্ত্র এবং দেশদেশান্তরের যতী-কিছু ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মসমাজ আছে সকলে একত্রে মিলিয়া তিলোত্তমার সৃষ্টির ন্যায় এই ব্ৰাহ্মধর্মকে সৃষ্টি করিয়া থাকে তথাপি এইরূপ অদ্ভুত সৃষ্টি যদি হিন্দুর ইতিহাসেই সম্ভবপর হইয়া থাকে তবে তাহা হিন্দুরাই । সূর্যের আলোক সূর্যেই সম্ভবপর হইয়াছে, কেহ কেহ বলেন সূর্য অসংখ্য উল্কাপিণ্ডকে নিরন্তর আত্মসাৎ করিয়া সেই আলোকের সঞ্চয় রক্ষা করিতেছে । তাহা সত্যও হইতে পারে, নাও হইতে পারে, তথাপি এই আলোক সূর্যেরই । আমি শাক খাইয়া ফল খাইয়া দুধ মাছ ভাত খাইয়া প্ৰাণধারণ করিতেছি বটে। তাই বলিয়া আমার প্রাণকে আমারই প্ৰাণ বলিয়া স্বীকার না। উৎপত্তি সম্বন্ধে তর্ক আছে । কেহ বলেন খ্রীস্টানধর্ম বৌদ্ধধর্ম হইতে চুরি, কেহ বলেন বৈষ্ণবধর্ম কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ করিয়া দেখাইবেন ব্ৰাহ্মধর্ম জগতের সকল ধর্মের চোরাইমালের ভাণ্ডার । কিন্তু উৎপত্তিঘটিত সমস্ত বাদবিবাদ সত্ত্বেও খ্রীস্টানধর্ম খ্রীস্টানধৰ্মই, বৈষ্ণবধর্ম বৈষ্ণবধর্মই । খ্রীস্টানধর্ম যদি বৌদ্ধধর্মকে আত্মসাৎ করিয়া থাকে, বৈষ্ণবধর্ম যদি খ্রীস্টানধর্মকে আত্মসাৎ করিয়া থাকে, তবে তাহাতে তাহার অস্তিত্ব লোপ হয় নাই, তাহার গৌরব খর্ব হয় নাই । অনাত্মকে গ্ৰহণ করিয়া আত্নীয়ে পরিণত করিবার শক্তিই জীবনের শক্তি- অনাত্যুের মধ্যে আত্মবিশেষত্ব বিলুপ্ত করিয়া দেওয়াই মৃত্যুর লক্ষণ । অতএব যেমন করিয়াই বিচার করি, হিন্দুর ইতিহাসে ব্ৰাহ্মধর্মের বিকাশ স্বদেশীয় বিদেশীয় যত৷-কিছু কারণ পরম্পরা অবলম্বন করিয়াই দেখা দিক-না তথাপি তাহা হিন্দুরই সামগ্ৰী । এই ইতিহাস আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করিতেছে না— ইহা আমার প্রিয় হইলেও সত্য, অপ্রিয় হইলেও সত্য । কিন্তু সকলের চেয়ে