পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা »०८ আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। লেখা ভালো হইয়াছে, কিন্তু উক্ত গ্রন্থে সর্বত্র তিনি তাহার নিজের সুর ভালো করিয়া লাগাইতে পারেন নাই। কেহ যদি প্ৰমাণ করে, যে, কোনো একটি ক্ষমতাশালী লেখক অনা একটি উপন্যাস অনুবাদ বা রূপান্তরিত করিয়া দুৰ্গেশনন্দিনী রচনা করিয়াছেন, তবে তাহা শুনিয়া আমরা নিতান্ত আশ্চর্য হই না। কিন্তু কেহ যদি বলে, বিষবৃক্ষ, চন্দ্ৰশেখর বা বঙ্কিমবাবুর শেষ-বেলাকার লেখাগুলি অনুকরণ, তবে সে কথা আমরা কানেই আনি না। ব্যক্তিবিশেষ সম্বন্ধে যাহা খাটে, জাতি সম্বন্ধেও তাঁহাই খাটে। চারি দিক দেখিয়া শুনিয়া আমাদের মনে হয় যে, বাঙালি জাতির যথার্থ ভাবটি যে কী তাহা আমরা সকলে ঠিক ধরিতে পারি নাইবাঙালি জাতির প্রাণের মধো ভাবগুলি কিরূপ আকারে অবস্থান করে তাহা আমরা ভালো জানি না। এই নিমিত্ত আধুনিক বাংলা ভাষায় সচরাচর যাহা কিছু লিখিত হইয়া থাকে তাহার মধ্যে যেন একটি খাটি বিশেষত্ব দেখিতে পাই না। পডিয়া মনে হয় না, বাঙালিতেই ইহা লিখিয়াছে, বাংলাতেই ইহা লেখা সম্ভব এবং ইহা অন্য জাতির ভাষায় অনুবাদ করিলে তাহারা বাঙালির হৃদয়-জাত একটি নূতন জিনিস লাভ করিতে পরিবে। ভালো হউক মন্দ হউক, আজকাল যে-সকল লেখা বাহির হইয়া থাকে তাহা পডিয়া মনে হয়, যেন এমন লেখা ইংরাজিতে বা অন্যান্য ভাষায় সচরাচর লিখিত হইয়া থাকে বা হইতে পারে ; ইহার প্রধান কারণ, এখনো আমরা বাঙালির ঠিক ভাবটি, ঠিক ভাষাটি ধরিতে পারি নাই! সংস্কৃতিবাগীশের বলিবেন, ঠিক কথা বলিয়াছ, আজকালকার লেখায় সমাস দেখিতে পাই না, বিশুদ্ধ সংস্কৃত কথার আদর নাই, এ কী বাংলা ; আমরা তাহদের বলি, তোমাদের ভাষাও বাংলা নহে, আর ইংরাজিওয়ালাদের ভাষাও বাংলা নহে। সংস্কৃত ব্যাকরণেও বাংলা নাই, আর ইংরাজি ব্যাকরণেও বাংলা নাই, বাংলা ভাষা বাঙালিদের হৃদয়ের মধ্যে আছে। ছেলে কোলে করিয়া শহরময় ছেলে খুজিয়া বেড়ানো যেমন, তোমাদের ব্যবহার ও তেমনি দেখিতেছি। তোমরা বাংলা বাংলা করিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছি, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট-পালট করিতেছি, কেবল একবার হৃদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান আমি কে তাই আমি জানলেম না, আমি আমি করি। কিন্তু আমি আমার ঠিক হইল না। চার কড়ায় এক গণ্ড গণি, কোথা হইতে এলাম। আমি তারে কই গণি ! আমাদের ভাব, আমাদের ভাষা আমরা যদি আয়ত্ত করিতে চাই, তবে বাঙালি যেখানে হৃদয়ের কথা বলিয়াছে, সেইখানে সন্ধান করিতে হয় । যাহাঁদের প্রাণ বিদেশী হইয়া গিয়াছে, তাহারা কথায় কথায় বলেন- ভােব সর্বত্রই সমান। জাতিবিশেষের বিশেষ সম্পত্তি কিছুই নাই! কথাটা শুনিতে বেশ উদার, প্রশস্ত। কিন্তু আমাদের মনে একটি সন্দেহ আছে। আমাদের মনে হয়, যাহার নিজের কিছু নাই, সে পরের স্বত্ব লোপ করিতে চায়। উপরে যে মতটি প্রকাশিত হইল, তাহা চৌর্যবৃত্তির একটি সুশ্রাব্য ছুতা বলিয়া বোধ হয়। যাহারা ইংরাজি হইতে দুই হাতে লুট করিতে থাকেন, বাংলাটাকে এমন করিয়া তোলেন যাহাতে তাহাকে আর ঘরের লোক বলিয়া মনে হয় না, তাহারাই বলেন ভাষাবিশেষের নিজস্ব কিছুই নাই, তাহারাই অম্লান বদনে পরের সোনা কানে দিয়া বেড়ান। আমারই যে নিজের সোনা আছে এমন নয়, কিন্তু তাই বলিয়া একটা মতের দোহাই দিয়া সোনাটাকে নিজের বলিয়া ভঁৰাক করিয়া বেড়াই না। ভিক্ষা করিয়া থাকি, তাতেই মনে মনে ধিককার জন্মে, কিন্তু আমন করিলে যে স্পষ্ট চুরি করা হয়। সাম্য এবং বৈষম্য, দুটাকেই হিসাবের মধ্যে আনা চাই। বৈষম্য না থাকিলে জগৎ টিকিতেই পারে না। সব মানুষ সমান বটে, অথচ সব মানুষ আলাদা। দুটাে মানুষ ঠিক এক ছাঁচের, এক ভাবের পাওয়া অসম্ভব, ইহা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না। তেমনি দুইটি স্বতন্ত্ৰ জাতির মধ্যে মনুষ্যস্বভাবের সাম্যও আছে, বৈষম্যও আছে। আছে বলিয়াই রক্ষা, তাই সাহিত্যে আদান-প্ৰদান বাণিজ্য-ব্যবসায়