পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

श्b እoዓ অপ্রেমিক বলিবে, এ প্রেমে লাভ কী? ফুলকে জিজ্ঞাসা করো না কেন, গন্ধ দান করিয়া তোমার লাভ কী? সে বলিবে, গন্ধ না দিয়া আমার থাকিবার জো নাই, তাহাঁই আমার ধর্ম! এইজন্য গন্ধ না দিতে পারিলে জীবন বৃথা মনে হয়। তেমনি প্রেমিক বলিবে মরণই আমার ধর্ম, না মরিয়া আমার সুখ নাই। লোভী লোভে গণিবে প্ৰমাদ, একের জন্য কি হয় আরের মরিতে সাধ । বাউল উত্তর করিল যার যে ধর্ম সেই পাবে সেই কর্ম। প্রেমের মর্ম কি অপ্রেমিকে পায় ? বাউল বলিতেছে, সমস্ত জগতের গান শুনিবার এক যন্ত্ৰ আছে ভাবের আজগবি কল গৌরচাদের ঘরে সে যে অনন্ত ব্ৰহ্মাণ্ডের খবর, আনছে একতারে গো সখি, প্রেম-তারে। প্রেমের তারের মধ্যে অনন্ত ব্ৰহ্মাণ্ডের তড়িৎ খেলাইতে থাকে, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের খবর নিমিষের মধ্যে প্ৰাণের ভিতর আসিয়া উপস্থিত হয়। যাহাকে তুমি ভালোবাসো তাহার কাছে বসিয়া থাকো, অদৃশ্য প্রমের তার দিয়া তাহার প্রাণ হইতে তোমার প্রাণে বিদ্যুৎ বহিতে থাকে, নিমেষে নিমেষে তাহার প্রাণের খবর তোমার প্রাণে আসিয়া পৌঁছায়। তেমনি যদি জগতের প্রাণের সহিত তোমার প্রাণ প্রেমের তারে বাধা থাকে তাহা হইলে জগতের ঘরের কথা সমস্তই তুমি শুনিতে পাও। প্রেমের মহিমা এমন করিয়া আর কে গাহিয়াছে। জগতের প্ৰেমে আমরা কেন মজিতে চাহি না ? আমরা আপনাকে বজায় রাখিতে চাই বলিয়া। আমরা চাই আমি বলিয়া এক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র করিয়া রাখিব, তাহাকে কোনোমতে হাতছাড়া করিব না। জগৎকে বেষ্টন করিয়া চারি দিকে প্রেমের জাল পাতা রহিয়াছে। অহনিশি জগতের চেষ্টা তোমাকে তাহার সহিত এক কবিয়া লইতে জগতের ইচ্ছা নহে যে, তাহার কোনো একটা অংশ, কোনো একটা ঢেউ, স্বাতন্ত্রা অবলম্বন করিয়া জগতের স্রোতকে হুট করিয়া দিয়া উজানে বহিয়া যায়। সে চায় সকল ঢেউগুলি একস্রোতে বহে, এক গান গায়, তাহা হইলেই সমস্ত জগতের একটি সামঞ্জস্য থাকেজগতের মহাগীতের মধ্যে কোনোখানে বেসুরা লাগে না। এই নিমিত্ত যে ব্যক্তি জগতের প্রতিকূলে “আমি আমি” করিয়া খাড়া থাকিতে চায় সে ব্যক্তি বেশি দিন টিকিতে পারে না! ক্ষুদ্র নিজের মধ্যে নিজের অভাব পূৰ্ণ হয় না। অবশেষে সে দুঃখে শোকে তাপে জর্জর হইয়া জগতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ইপি ছাড়ে। এক গণ্ডুষ জলের মধ্যে মাছ কতক্ষণ তিষ্ঠিতে পারে? কিছু দিনের মধ্যেই তাহার খোরাক ফুরাইয়া যায়, জল দূষিত হইয়া পড়ে, সমুদ্রের জন্য তাহার প্রাণ ছটফট করে। তখন সমুদ্রে যদি না যাইতে পারে, বড়ো মাছ হইলে শীঘ্ৰ মরে, ছোটাে মাছ হইলে কিছু দিন মাত্র টিকিয়া থাকে। তেমনি যাহাঁদের বড়ো প্ৰাণ তাহারা বেশি দিন নিজের মধ্যে বন্ধ হইয়া থাকিতে পারে না, জগতে ব্যাপ্ত হইতে চায়। চৈতন্যদেব ইহার প্রমাণ। যাহাঁদের ছোটো প্ৰাণ তাহারা অনেকদিন নিজেকে লইয়া টিকিতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া চিরকাল পরিবে না, অনন্তকালের খোরাক আমার মধ্যে নাই। দুর্ভিক্ষে পীড়িত হইয়া তাহারা বাহির হইয়া পড়ে। এত কথা যে বলিলাম তাহা নিম্নলিখিত গানটির মধ্যে আছে।- ওরে মন পাখি, চাতুরী করবে বলে কত আর! বিধাতার প্রেমের জালে পড়বে না কি একবার! সাবধানে ঘুরে ফিরে থাক বাহিরে বাহিরে, জাল কেটে পালাও উড়ে ফাকি দিয়ে বারবার! তোমায় একদিন ফাদে পড়তে হবে, সবােচালাকি ঘুচে যাবে অন্ন জল বিনে যখন করবে। দুঃখে হাহাকার!