পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনী > ○> হৃদয়ের যতটা বলের আবশ্যক তাহা নাই। এ কথা যে সম্পূর্ণ অমূলক তাহা নহে, কিন্তু ইহা ছাড়া আরো কতকগুলি কারণ জুটিয়াছে। V সমাজ যখন সমস্যা হইয়া দাড়ায় তখন মানুষ সবলে কাজ করিতে পারে না, যখন ডান পা একটি গর্তের মধ্যে নিবিষ্ট করিয়া বা পা কোথায় রাখিব ভাবিয়া পাওয়া যায় না, তখন দ্রুতবেগে চলা অসম্ভব। কিংবা যখন মাথা টলমল করিতেছে কিন্তু পা শক্ত আছে, অথবা মাথার ঠিক আছে কিন্তু পায়ের ঠিকানা নাই- তখন যদি চলিবার বিশেষ ব্যাঘাত হয় তবে জমির দোষ দেওয়া যায় না। আমরা বঙ্গসমাজ-নামক যে মাকড়সার জালে মাছির ন্যায় বাস করিতেছি, এখানে মতামত-নামক আসমানগামী ডানা দুটাে খোলসা আছে বটে কিন্তু ছটা পা জড়াইয়া গেছে ! ডানা আস্ফালন যথেষ্ট হইতেছে কিন্তু উড়িবার কোনো সুবিধা হইতেছে না। এখানে ডানা-দুটাে কেবল কষ্টেরই কারণ হইয়াছে। যেটা ভালো বলিয়া জানিলাম সেটা ভালো রকম হইয়া উঠে না- জ্ঞানের উপর বিশ্বাস হ্রাস হইয়া যায়। যে উদ্দেশ্যে যে কাজ আরম্ভ করিলাম পদে পদে তাহার উলটা উৎপত্তি হইতে লাগিল, সে কাজে আর গা লাগে না। صميم আমাদের সমাজ যে উত্তরোত্তর জটিল সমস্যা হইয়া উঠিতেছে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কেহ বলিতেছে বিধবাবিবাহ ভালো, কেহ বলিতেছে মন্দ; কেহ বলিতেছে বাল্যবিবাহ উচিত, কেহ বলিতেছে অনুচিত; কেহ বলে পরিবারের একান্নবর্তিত উঠিয়া গেলে দেশের মঙ্গল, কেহ বলে অমঙ্গল। আসল কথা, ভালো কি মন্দ কোনোটাই বলা যায় না- কোথাও বা ভালো কোথাও বা মন্দ। বর্তমান বঙ্গসমাজ যে এতটা ঘোলাইয়া গিয়াছে তাহার গুরুতর কারণ আছে। প্ৰাচীন কালে স্ত্রী পুরুষ বা সমাজের উচ্চ-নীচ শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার ন্যুনাধিক্য ছিল বটে, কিন্তু শিক্ষার সাম্যও ছিল। সকলেরই বিশ্বাস, লক্ষ্য, আকাঙক্ষা, রুচি ও ভাব এক প্রকারের ছিল। সমাজসমুদ্রের মধ্যে তরঙ্গের উচু-নিচু অবশ্যই ছিল, কিন্তু তেলে জলের মতো একটা পদার্থ ছিল না। পরস্পরের মধ্যে যে বিভিন্নতা ছিল তাহার ভিতরেও জাতীয় ভাবের একটি ঐক্য ছিল, সুতরাং এরূপ সমাজে জটিলতার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সে সমাজ সবল ছিল কি দুর্বল ছিল সে কথা হইতেছে না, কিন্তু তাহার সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্য ছিল, অর্থাৎ তাহার অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গের মধ্যে সামঞ্জস্য ছিল। কিন্তু এখন সেই সামািজস্য নষ্ট হইয়া গেছে। সেইজন্য বা কান এক শোনে, ডান কান আর শোনো; তুমি মাথা নাড়িতে চাহিলে, তোমার দুই পায়ের দুই বুড়ো আঙুল নড়িয়া উঠিল! এক করিতে আর হয়। আমাদের দেশে ইংরাজি শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে বিজাতীয় প্রভেদ দাড়াইয়াছে। সুতরাং স্ত্রী পুরুষের মধ্যে, উচ্চ নীচের মধ্যে, প্রাচীন নবীনের মধ্যে, অর্থাৎ বাপে বেটায়, এক প্রকার জাতিভেদ হইয়াছে! যেখানে জাতিভেদ আছে অথচ নাই, সেখানে কোনো কিছুর হিসাব ঠিক থাকে না। দুই বৃক্ষ দুই দিকে যদি মুখ করিয়া থাকে তাহাতে উদ্ভিদরাজ্যের কোনো ক্ষতি হয় না- কিন্তু যেখানে ডালের সঙ্গে গুড়ির, আগার সঙ্গে গোড়ার মিল হয় না, সেখানে ফুলের প্রত্যাশা করিতে গেলে আকাশকুসুম পাওয়া যায় এবং ফলের প্রত্যাশা করিতে গেলে কদলীও মিলে না। আমাদের সমাজ যদি গাছপাকা হইয়া উঠিত। তবে আর ভাবনা থাকিত না; তাহা হইলে আঁঠিতে খোসাতে এত মনান্তর, মতান্তর, অবস্থান্তর থাকিত না। কিন্তু হিন্দুসমাজের শাখা হইতে পাড়িয়া বঙ্গসমাজকে বলপূর্বক পাকানো হইতেছে। ইহার একটা আশু উপকার এই দেখা যায় অতি শীঘ্রই পাক ধরে, গাছে পাচ দিনে যাহা হয়। এই উপায়ে এক দিনেই তাহা হয়। বঙ্গসমাজেও তাহাই হইতেছে। বঙ্গসমাজের যে অংশে ইংরাজি সভ্যতার তাত লাগিতেছে সেখানটা দেখিতে দেখিতে লাল হইয়া উঠিতেছে, কিন্তু শ্যামল অংশটুকুর সঙ্গে তাহার কিছুতেই বনিতেছে না!! এরূপ ফলের মধ্যে সহজ নিয়ম আর খাটে না। পুরুষদের মধ্যে ইংরাজি শিক্ষা ব্যাপ্ত হইয়াছে, শ্ৰীলোকদের মধ্যে হয় নাই। শিক্ষার প্রভাবে পুরুষেরা স্থির করিয়াছেন বাল্যবিবাহ দেশের পক্ষে অমঙ্গলজনক- ইহাতে সন্তান দুর্বল হয়, অল্প