পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS O রবীন্দ্র-রচনাবলী বয়সে বহু পরিবারের ভারে সংসারসাগরে অশ্রুপূৰ্ণ লােনাজলে হাবুডুবু খাইতে হয় ইত্যাদি। এই শিক্ষার গুণে তাহারা আত্মসংযমপূর্বক নিজের ও দেশের দূর মঙ্গল ও অমঙ্গলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া অধিক বয়সে বিবাহ করিবার পক্ষে উপযোগী হন । কিন্তু স্ত্রীলোকেরা এরূপ শিক্ষা পান নাই এবং অধিক বয়সে বিবাহ করিবার জন্য প্ৰস্তুতও হন নাই ? তাহারা অন্তঃপুরের পুরাতন প্রথার মধ্যে, ঠাট্টার সম্পৰ্কীয়দের চিরন্তন উপহাস-বিদ্রুপের মধ্যে, বিবাহ প্রভৃতি গৃহকর্মের নানাবিধ আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানের মধ্যে আশৈশব লালিতপালিত হইয়াছেন ; আপিসের অন্নের ন্যায় প্রত্যুষেই তাহাদিগকে খরতাপে চড়ানো হইয়াছে, এবং ক্রমাগত গরম মসলা পড়িতেছে- চেষ্টা হইতেছে যাহাতে দশ, বড়ো জোর সাড়ে দশের আগেই রীতিমত ক'নে পাকাইয়া তাহাদিগকে ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যাইতে পারে । সুতরাং স্ত্রীলোকদের বাল্যবিবাহ আবশ্যক। কিন্তু পুরুষেরা অধিক বয়সে বিবাহ করিতে কৃতসংকল্প হইলে মেয়েদের বর শীঘ্ৰ জুটিবে না- তাহাদিগকে দায়ে পডিয়া অপেক্ষা করিতে হইবে। তাহা ছাড়া অধিকবয়স্ক পুরুষের নিতান্ত অল্পবয়স্ক কন্যাকে বিবাহ করিতে সম্মতও হইবেন না! অথচ বহুদিন তো প্রচলিত হইয়াছে ; কিন্তু সে কি আর শিক্ষা দ্য গোটা দুই ইংরাজি প্রাইমার গিলিয়া, এমন-কি এনট্রেন্সের পড়া পড়িয়াও কি কঠোর কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয়ের শক্তি জন্মে ? শত শত বৎসরের পুরুষানুক্রমবাহী সংস্কারের উপরে মাথা তুলিয়া উঠা অল্প শিক্ষা ও অল্প বলের কাজ নহে ।" রীতিমত স্ত্রীশিক্ষা প্ৰচলিত হওয়া ও অন্তঃপুরের চিরন্তন আবহাওয়ার পরিবর্তন হওয়া এখন অনেক দিনের কথা ! অথচ বাল্যবিবাহের প্রতি বিদ্বেষ আজই জাগিয়া উঠিয়াছে; এখন কী করা যায়। একান্নাবতী পরিবারের মধ্যে বাস করিতেছি, অথচ বাল্যবিবাহ উঠাইতে চাই ; একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে অধিকবয়স্ক নূতন লোক প্রবেশ করিতে পারে না " চরিত্রগঠনের পূর্বেই উক্ত পরিবারের সহিত লিপ্ত হওয়া চাই, নতুবা সেই নূতন লোক অচর্কিত কঠিন খাদ্যের ন্যায় পরিবারের পাকস্থলীতে প্ৰবেশ। এই যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া গেল। তেমনি আরেক শ্রেণীর আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক । ইংরাজি শিক্ষা সত্ত্বেও কেহ কেহ এমন বিবেচনা করেন যে, বিধবাবিবাহ প্ৰচলিত হওয়া উচিত নহে। বিধবাদের পক্ষে ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকার অপেক্ষা মহত্ত্ব আর কী হইতে পারে ? ইহাতে পরিবারের মধ্যে একটি পবিত্ৰ আদর্শের প্রতিষ্ঠা করা হয় । যখন আজন্মকালের শিক্ষা ও উদাহরণের প্রভাবে বঙ্গনার স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করিতস্বামীকেই স্ত্রীলোকের চরম গতি পরম মুক্তির কারণ বলিয়া জানিত, তখন বিধবাদের ব্ৰহ্মচর্য পালন করা স্বাভাবিক ছিল, এবং না করা দৃষ্য ছিল ! কিন্তু সে শিক্ষা, সে উদাহরণ, সে ভােব চলিয়া যাইতেছে, ফল নাই, তাহার আভ্যন্তরিক ভাবেই তাহার মহােৱ ! এক কালে আমাদের সমাজ ভক্তি ও মেহের সূত্রেই গাথা ছিল। তখন পুত্র পিতাকে, শিষ্য গুরুকে, ছোটাে ভাই বড়ো ভাইকে, সমস্ত স্নেহাস্পদেরা সমস্ত গুরুজনদের অসীম ভক্তি করিত। সমাজের সে অবস্থায় স্ত্রী ও স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করিত । সমাজের সমস্ত সুর এক হইয়া মিলিত । এখন স্বতন্ত্র শিক্ষার প্রভাবে সমাজের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ কতকটা একাকার হইয়া পড়িতেছে ; এখন বড়ো ভাইকে ছোটো ভাই, গুরুজনদিগকে স্নেহাস্পদেরা, এমন-কি পিতাকে পুত্র, তেমন ভাবে দেখে না, তেমন করিয়া মানে না-ইহা কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। এই সংক্রামক ভাব যদি সমাজের সর্বত্রই আক্রমণ করিয়া থাকে। তবে কি কেবল পতি-পত্নীর সম্পর্কই ইহার হাত হইতে রক্ষা পাইতে পারে ? তাহদের মধ্যেও কি সাম্যভাব প্ৰবেশ করে নাই, অথবা দ্রুতবেগে করিতেছে না ? চারি দিকের উদাহরণে এই ভক্তির ভাব কি মন হইতে শিথিল হইয়া যায় নাই ? আগেকার বউরা শাশুড়িকে যেরূপ মান্য করিত এখনকার বউরা কি তেমন মান্য করে ? শাশুড়ির প্রতি যে কারণে ভক্তির লাঘব হইয়াছে সেই কারণেই কি স্বামীর প্রতিও