পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܐܶܢ ܠ হইয়া যায়। বিশেষত অনভাসের সংকোচ যত গুরুতর, নিয়মের আঁাটার্তমাটি তত গুরুতর নহে। অন্তঃপুর হইতে বাহির হইবার অনভ্যাস যদি অল্পে অল্পে হ্রাস হইয়া যায়, তাহা হইলে সমাজনিয়মের বাধা আর বড়ো কাজে লাগে না। আর একটা দেখিতে হয়- পূর্বে অবরোধপ্রথা সর্ববাদি সম্মত ছিল, সুতরাং তাহার ক্ষমতা অক্ষুন্ন ছিল। এখন কেহ-বা বাহিরে যান কেহ-বা যান না। যাহারা না যান তাহারা প্রসঙ্গক্রমে নানা গল্প শুনিতে পান, নানা উদাহরণ দেখিতে পান। সুতরাং স্বভাবতই বাহিরে যাওয়া মাত্রই তাহদের তেমন বিভীষিকা বলিয়া বোধ হয় না, এমন-কি বাহিরে যাইতে অনেক কারণে তাহদের কৌতুহলও জন্মে : কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না। এবারকার একজিবিশনে যত পুরনারী-সমাগম হইয়াছিল, বিশ বৎসর পূর্বে ইহার সিকি হইবারও সম্ভাবনা ছিল না। সমাজের পরিবর্তনের প্রবল প্রভাবে সেই যদি মেয়েরা বাহির হইতেছেন, তবে মূঢ়ের মতো ইহা দেখিয়াও না দেখিবার ভান করা বৃথা। ইহার জনা প্ৰস্তুত হইতে হইবে । প্ৰস্তুত না হইলে সমাজের বর্তমান অবস্থায় মেয়েরা সেই বাহির হইবে- তবে অপ্ৰস্তুত ভাবে হইবে । তাহার দৃষ্টান্ত দেখো। অনেক ভদ্র পরিনারী অন্তঃপুরের প্রাচীর যখন আবরণের কাজ করে তখন যাহা হয় একটা বস্ত্র পরার উপলক্ষ রক্ষা করে। আর না করো সে তোমার রুচির উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাহির হইতে হইলে সমাজের মুখ চাহিয়া লজ্জােরক্ষার উপায় অবলম্বন করিতে হইবে- রীতিমত ভদ্রবেশ পরিতে হইবে । পুরুষদের পরিতে হইবে অথচ মেয়েদের পবিতে হইবে না, ইহা কোন শাস্ত্রে লেখে? ভদ্র পুরুষরা যখন জামা না পরিয়া বাহির হইতে বা ভদ্রসমাজে যাইতে লজ্জা বোধ করেন, তখন ভদ্র স্ত্রীরা কী করিয়া শুদ্ধমাত্র একখানি বহু যত্নে সংবরণীয় সূক্ষ্ম শাড়ি পরিয়া ভদ্রসমাজে বাহির হইবেন! আজকাল এরূপ রীতিগহিত ব্যাপার যে ঘটিতেছে, তাহার কারণ অভিভাবকদের এ বিষয়ে মতের স্থৈর্য নাই, একটা হিজিবিজি কাণ্ড হইতেছে। অন্তঃপুর হইতে স্ত্রীলোকদিগকে বাহিরে আনা তাহদের মতও নয়, অথচ আনিতেও হইবে- এইজন্য অত্যন্ত অশোভনভাবে কার্য নির্বাহ করা হয়। গাহের স্ত্রীলোকদিগকে সর্বজনসমক্ষে এরূপ ভাবে বাহির করিলে তাহদের অপমান করা হয় | আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবাসীদের উপহাস বিদ্রুপ উপেক্ষা করিয়া পুরস্ত্রীদিগকে যদি ভদ্রবেশ পরানো অভ্যাস করাও, তবে তাহাদিগকে বাহিরে আনিতে পারে।- নতুবা উচকা মত বা উপস্থিত সুবিধার খাতিরে এরূপ ভদ্রজননিন্দনীয় ভাবে স্ত্রীলোকদিগকে বাহিরে আনিলে সমস্ত ভদ্র বঙ্গসমাজকে বিষম লােজায় ফেলা হয়। এক দল লোক আছেন তাহারা আধাআধি রকম সমাজসংস্কার করিতে চান। “এক-চোখো সংস্কার” নামক প্ৰবন্ধে তাহদের সংস্কারকার্যের বিষয়ে বিস্তারিত করিয়া লিখিয়াছি। স্বামীর মৃত্যুর পরে পুনরায় বিবাহ করিলে পবিত্র দাম্পত্য ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়, এ বিষয়ে অনেকের সংশয় নাই। কিন্তু, পৃথিবীর সুখ হইতে বিধবাদিগকে বঞ্চিত করা তাহারা নিষ্ঠুরতা জ্ঞান করেন। কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যায় বিধবাদিগকে পৃথিবীর সুখে মগ্ন করিয়া রাখাই প্ৰকৃত নিষ্ঠুরতা। অতএব একটাকে ছাড়িয়া আর একটা রাখিতে গেলে, ঘাড়কে ছাটিয়া মাথা রাখিতে গেলে, বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। এমন জটিল সমস্যার মধ্যে বাস করিয়া সাম্প্রদায়িকতার অনুরোধে ব্যক্তিবিশেষের সামাজিক স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ করা অন্ধ গোড়ামির কার্য। যদি কোনো সম্প্রদায় এমন আইন জারি করেন, দিতেই হইবে, অবরোধপ্রথা ভাঙিতেই হইবে, তবে তাহাতে সমাজের অপকার হইতে পারে। মূল ধর্মনীতিসমূহের ন্যায় সমাজনীতি সকল অবস্থায় সকল লোকের পক্ষে উপযোগী না হইতে পারে। পরিবারবিশেষে বাল্যবিবাহ উঠিয়া গেলেও হানি নাই, কিন্তু সকল পরিবারেই এ কথা খাটে না। পরিবারবিশেষে বিধবাবিবাহ হইবার সুবিধা আছে, কিন্তু সকল পরিবারে নাই। স্ত্রীবিশেষ স্বাধীনতার উপযোগী। কিন্তু সকল শ্ৰী নহে। যাহারা বলপূর্বক সমাজে একটা বিশৃঙ্খলা জন্মাইয়া দিতে চান, তাহারা