পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা Σ Σ. Ο যতই স্কীত হউন-না কেন, তাহাদিগকে সমাজের গাত্রে একটি সুমহৎ ক্ষত বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে। সকল অবস্থাতেই আইনপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধ করিলে সমাজে দুনীতি প্রশ্রয় পাইতে পারে। অবস্থানিবিচারে বিবাহাথিনী বিধবা মাত্রেই বিবাহ দিতে গেলে অস্বাস্থ্যজনক উচ্ছঙ্খলতা উপস্থিত হয়। স্ত্রী মাত্রেরই স্বাধীনতা দিতে গেলেই বঙ্গীয়সমাজকে অপদস্থ হইতে হয়। তেমনি আবার একমাত্র নিয়ম বলিয়া অবলম্বন করা, সকল অবস্থাতেই সকল বিধবার স্কন্ধেই বলপূর্বক ব্ৰহ্মচর্য বোঝা চাপাইয়া দেওয়া এবং স্ত্রীলোকদিগকে কোনো মতেই এবং কোনো কালেই অন্তঃপুরের বাহিরে আনিবার চেষ্টা না করা অত্যন্ত অন্ধপ্ৰথাঞ্চলবর্তিতার পরিচায়ক। অতএব এই-সকল সমস্যার প্রতি মনোযোগ করিয়া এক প্রকার গোয়াতুমি গোড়ামি পরিত্যাগ করো। শান্ত সংযতভাবে সমাজসংস্কারের প্রতি মন দাও ; অথচ বাধন ছিড়িবার উপলক্ষে তুচ্ছতর সাম্প্রদায়িক বাধনে সমাজের পক্ষুদের জড়াইয়ে না। এক-চোখো সংস্কার সংস্করণের অর্থ স্বাধীনতা-উপার্জন। বাল্যাবস্থায় সমাজের শত সহস্ৰ বন্ধন থাকে, শত সহস্র অনুশাসনে তাহাকে সংযত করিয়া রাখিতে হয়। সে সময়ে তাহার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য স্মৃতিকে দমন কবিয়া রাখাই তাহার কল্যাণের হেতু । অবশেষে সে যখন বড়ো হইতে থাকে তখন একে একে সে একএকটি বন্ধন ছিডিয়া ফেলিতে চায়, শাস্ত্রের এক-একটি কঠোর আদেশ কণ্ঠ হইতে অবতারণা করিতে চায়, লোকাচারের এক-একটি দুৰ্ভেদ্য প্রাচীরের তলে তলে গোপনে ছিদ্র করিয়া দেয় ও অবশেষে একদিন প্রকাশ্যে বারুদ লােগাইয়া সমস্তটা উড়াইয়া দেয়। ইহাকেই বলে সংস্করণ। তাই বলিতেছি। সংস্করণের নাম স্বাধীনতার প্রয়াস ; গুটিপোকা যখন প্ৰজাপতি হইয়া তাহার রেশমের কারাগার ভাঙিয়া ফেলে তখন সে সংস্কার করে। মাকড়সা যখন আপনার রচিত জালে জড়াইয়া পডিয়া মুক্ত হইবার জন্য যুঝিতে থাকে তখন সে এক জন সংস্কারক। দুর্ভাগ্যক্রমে মনুষ্যসমাজ-সংস্কার সাপের খোলস ছাড়ার মতো একটা সহজ ব্যাপার নহে। খোলসের প্রতি এত মায়া মনুষ্যসমাজ ব্যতীত আর কাহারও নাই। মন্তানকে শাসন করা, সন্তানকে পালন করা তাহার শিশু-অবস্থার উপযোগী; কিন্তু সে অবস্থা অতীত হইলেও অনেক পিতা মাতা তাহাদিগকে শাসন করেন, তাহাদিগকে বলপূর্বক পালন করেন, তাহাদিগকে যথোপযোগী স্বাধীনতা দেন না। সন্তানের বর্ষে বর্ষে পরিবর্তন আছে, অথচ পিতা মাতার কর্তব্যের পরিবর্তন নাই। ইহার ফল হয় এই যে, একদিন সহসা তাহারা দেখিলেন- সন্তান তাহদের একটি আদেশ শুনিল না, মাঝে মাঝে এক-একটা বিষয়ে তাহদের অবাধ্যতা করিতে লাগিল। তাহদের কখনো এরূপ অভ্যাস ছিল না; বরাবর তাহদের আদেশ পালিত হইয়া আসিতেছে, আজ সহসা তাহার অন্যথা দেখিয়া তাহদের গায়ে সহ্য হয় না। উভয় পক্ষে একটা সংঘর্ষ বাধিয়া যায়। ইহাকেই বলে বিপ্লব। অবশেষে একে একে সে পিতা মাতার একটি একটি শাসন হইতে আপনাকে মুক্ত করিতে থাকে, তাহার স্বাধীনতার সীমা পদে পদে বৃদ্ধি করিতে থাকে ও অবশেষে স্বাতন্ত্রী লাভ করেইহাকেই বলে সংস্কার। বৃদ্ধ লোকেরা আক্ষেপ করিতে থাকেন যে, সন্তানদের অবনতি হইল; স্বাধীনতাই লাভ করুক, আর আত্মনির্ভরই শিখুক, আর আলস্যই পরিহার করুক, যখন গুরুজনের অবাধ্য হইল। তখন আর তাহদের শ্রেয় কোথায়? অবাধ্য না হইলেই ভালো ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু সংসারে যদি কোনো মঙ্গল না যুঝিয়া না পাওয়া যায়, সকলই যদি কড়িয়া লইতে হয়, কিছুই যদি চাহিয়া না পাওয়া যায়, তাহা হইলে অবাধ্য না হইয়া আর গতি কোথায় ? উপরের কথাটা আর একটু বিস্তুত করিয়া বলা আবশ্যক। পৃথিবীতে কিছুই সর্বতোভাবে পাওয়া যায় না। সাধারণত বলিতে গেলে অধীনতা মাত্রই অশুভ, স্বাধীনতা মাত্রই শুভ। মানুষের প্রাণপণ N ( r