পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܠ ܠ ܠ কোনো নিন্দা করিত না।” এক কালে যে লোকাচারের প্রাচীরটি আশ্রয়স্বরূপ ছিল, আর-এক কালে তাহাই কারাগার হইয়া দাড়ায়। এক দল কামান লইয়া বলে, “ভাঙিয়া ফেলিব।’ আর-এক দল রাজমিন্ত্রির যন্ত্ৰাদি আনিয়া বলে, “না, ভাঙিয়া কাজ নাই, গোটাকতক খিড়কির দরজা তৈরি করা যাক।” আমনি সমাজ স্থাপ ছাড়িয়া বলে, “হা, এ বেশ কথা !" এইরূপে আমাদের অসংখ্য লোকাচারের প্রাচীরে খিড়কির দরজা বসিয়াছে! প্রত্যহ একটি একটি করিয়া বাড়িতেছে: অবশেষে যখন দেখিবে তাহার নিয়মসমূহে এত খিড়কির দরজা হইয়াছে যে তাহার প্রাচীরত্ব আর রক্ষা হয় না, তখন সমস্তটা ভাঙিয়া, ফেলিতে আর আপত্তি করিবে না, এমন-কি, তখন ভাঙিয়া ফেলাও আর আবশ্যক হইবে না। এইরূপে এক-চোখো সংস্কারকগণ নিজের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে যতটা সমাজসংস্কার করেন, এমন অল্প সংস্কারকই করিয়া থাকেন। ইহার রক্ষণশীলদলভুক্ত হইয়াও উৎপাটনশীলদিগকে সাহায্য করেন। একটি পুরাতন কথা অনেকেই বলেন, বাঙালিরা ভাবের লোক কাজের লোক নহে ! এইজনা তাহাব বাঙালিদিগকে পরামর্শ দেন “ Practical হও’ ! ইংরাজি শব্দটাই ব্যবহার করিলাম। কারণ, ঐ কথাটাই চলিত। শব্দটা শুনিলেই সকলে বলিবেন, হা হা, বটে, এই কথাটাই বলা হইয়া থাকে বটে। আমি তাহার বাঙালী practical হওয়া কাহাকে বলে, তাহারা উত্তর দেন— ভাবিয়া চিন্তিয়া ফলাফল বিবেচনা করিয়া কাজ করা, সাবধান হইয়া চলা মোটা মোটা উন্নত ভাবের প্রতি বেশি আস্থা না রাখা, অর্থাৎ ভাবগুলিকে ছাটিয়া ছুটিয়া কাৰ্যক্ষেত্রের উপযোগী করিয়া লওয়া। খাটি সোনায় যেমন ভালো মজবুত গহনাগড়ানো যায় না, তাহাতে মিশাল দিতে হয়; তেমনি খাটি ভাব লইয়া সংসারের কাজ চলে না, তাহাতে খাদ মিশাইতে হয়! যাহারা বলে সত্য কথা বলিতেই হইবে তাহারা sentimental লোক, কেতাব পড়িয়া তাহারা বিগড়াইয়া গিয়াছে, আর যাহারা আবশ্যকমত দুই-একটা মিথ্যা কথা বলে ও সেই সামান্য উপায়ে সহজে কাৰ্যসাধন করিয়া লয় তাহারা practical লোক । এই যদি কথাটা হয়, তবে বাঙালি দিগকে ইহার জন্য অধিক সাধনা করিতে হইবে না। সাবধানী ভীরু লোকের স্বভাবই এইরূপ : এই স্বভাব্যবশতই বাঙালিরা চাকরি করিতে পারে। কিন্তু কাজ চালাইতে পারে না ! উল্লিখিত শ্রেণীর practical লোক ও প্রেমিক লোক এক নয়। practical লোক দেখে ফল কীপ্রেমিক তাহা দেখে না, এই নিমিত্ত সেইই ফল পায়। জ্ঞানকে যে ভালোবাসিয়া চৰ্চা করিয়াছে সেই জ্ঞানের ফল পাইয়াছে: হিসাব করিয়া যে চর্চা করে তাহার ভরসা এত কম যে, যে শাখা গ্রে জ্ঞানের ফল সেখানে সে উঠিতে পারে না, সে অতি সাবধানসহকারে হাতটি মাত্র বাড়াইয়া ফল পাইতে চায়কিন্তু ইহারা প্রায়ই বেঁটে লোক হয়, সুতরাং “প্ৰাংশুলভো ফলে লোভাদুদ্ধাহুরিব বামনঃ" হইয়া পড়ে। বিশ্বাসহীনেরাই সাবধানী হয়, সংকুচিত হয়, বিজ্ঞ হয়, আর বিশ্বাসীরাই সাহসিক হয়। উদার হয়, উৎসাহী হয়, এইজন্য বয়স হইলে সংসারের উপর হইতে বিশ্বাস হ্রাস হইলে পর। তবে সাবধানিতা বিজ্ঞতা আসিয়া পড়ে । এই অবিশ্বাসের আধিক্যহেতু অধিক বয়সে কেহ একটা নূতন কাজে হাত দিতে পারে না, ভয় হয় পাছে কার্যসিদ্ধি না হয়--- এই ভয় হয় না। বলিয়া অল্প বয়সে অনেক কার্য হইয়া উঠে, এবং হয়তো অনেক কাৰ্য অসিদ্ধও হয় । মানুষের প্রধান বল আধ্যাত্মিক বল ; মানুষের প্রধান মনুষ্যত্ব আধ্যাত্মিকতা শারীরিকতা ও মানসিকতা দেশ কাল পাত্র আশ্রয় করিয়া থাকে ; কিন্তু আধ্যাত্মিকতা অনন্তকে আশ্রয় করিয়া থাকে ।