পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা SS - অনন্ত দেশ ও অনন্ত কালের সহিত আমাদের যে যোগ আছে, আমরা যে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র নহি, ইহাই অনুভব করা আধ্যাত্মিকতার একটি লক্ষণ। যে মহাপুরুষ এইরূপ অনুভব করেন, তিনি সংসারের কাজে গোজামিলন দিতে পারেন না। তিনি সামান্য সুবিধা অসুবিধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। তিনি আপনার জীবনের আদর্শকে লইয়া ছেলেখেলা করিতে পারেন না- কর্তব্যের সহস্ৰ জায়গায় ফুটা করিয়া পালাইবার পথ নির্মাণ করেন না। তিনি জানেন অনন্তকে ফাকি দেওয়া চলে না। সত্যই আছে, অনন্তকাল আছে, অনন্তকাল থাকিবে- মিথ্যা আমার সৃষ্টি- আমি চোখ বুজিয়া সত্যের আলোক আমার নিকটে রুদ্ধ করিতে পারি, কিন্তু সত্যকে মিথ্যা করিতে পারি না। অর্থাৎ ফাকি আমাকে দিতে পারি, কিন্তু সত্যকে দিতে পারি না। মানুষ পশুদের ন্যায় নিজে নিজের একমাত্র সহায় নহে। মানুষ মানুষের সহায়। কিন্তু তাহাতেও তাহার চলে না। অনন্তের সহায়তা না পাইলে সে তাহার মনুষ্যত্বের সকল কাৰ্য সাধন করিতে পারে না। কেবলমাত্র জীবন রক্ষা করিতে হইলে নিজের উপরেই নির্ভর করিয়াও চলিয়া যাইতে পারে, স্বত্বরক্ষা করিতে হইলে পরস্পরের সহায়তা আবশ্যক, আর প্রকৃতরূপ আত্মরক্ষা করিতে হইলে অনন্তের সহায়তার আবশ্যক করে। বলিষ্ঠ নিভীক স্বাধীন উদার আত্মা সুবিধা, কৌশল, আপাতত প্রভৃতি পৃথিবীর আবর্জনার মধ্যে বাস করিতে পারে না! তেমন অস্বাস্থ্যজনক স্থানে পড়িলে ক্ৰমে সে মলিন দুর্বল রুগণ হইয়া পড়িবেই। সাংসারিক সুবিধাসকল তাহার চতুর্দিকে বলীকের স্তুপের মতো উত্তরোত্তর উন্নত হইয়া উঠিবে বটে, কিন্তু সে নিজে তাহার মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া প্রতি মুহুর্তে জীর্ণ হইতে থাকিবে } বিবেচনা বিচার বুদ্ধির বল সামান্য। তাহা চতুর্দিকে সংশয়ের দ্বারা আচ্ছন্ন, তাহা সংসারের প্রতিকূলতায় শুকাইয়া যায়- অকুলের মধ্যে তাহা ধ্রুবতারার ন্যায় দীপ্তি পায় না। এইজনাই বলি, সামান্য সুবিধা খুজিতে গিয়া মনুষ্যত্বের ধ্রুব উপাদানগুলির উপর বুদ্ধির তীক্ষামুখ ক্ষুদ্র কাচি চালনা করিয়ো না। কলস যত বড়োই হউক না, সামান্য ফুটা হইলেই তাহার দ্বারা আর কোনো কাজ পাওয়া যায় না। তখন যাহা তোমাকে ভাসাইয়া রাখে তাহা তোমাকে ডুবায়। ধর্মের বল নাকি অনন্তের নিঝর হইতে নিঃসৃত এইজনাই সে আপাতত অসুবিধা, সহস্রবার পরাভব, এমন-কি, মৃত্যুকে পর্যন্ত ডরায় না। ফলাফললাভেই বৃদ্ধিবিচারের সীমা, মৃত্যুতেই বুদ্ধিবিচারের সীমা, কিন্তু ধর্মের সীমা কোথাও নাই । অতএব এই অতি সামান্য বুদ্ধি বিবেচনা বিতর্ক হইতে কি একটি সমগ্র জাতি চিরদিনের জন্য পুরুষানুক্রমে বল পাইতে পারে! একটি মাত্র কুপে সমস্ত দেশের তৃষা নিবারণ হয় না। তাহাও আবার গ্ৰীষ্মের উত্তাপে শুকাইয়া যায়। কিন্তু যেখানে চিরনিঃসৃত নদী প্রবাহিত সেখানে যে কেবলমাত্র তুষানিবারণের কারণ বর্তমান তাহা নহে, সেখানে সেই নদী হইতে স্বাস্থ্যজনক বায়ু বহে, দেশের মলিনতা অবিশ্রাম ধৌত হইয়া যায়, ক্ষেত্ৰ শস্যে পরিপূর্ণ হয়, দেশের মুখশ্ৰীতে সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত সমাজের রক্ষা হয়, আবার তাহার আনুষঙ্গিকস্বরূপে চতুর্দিক হইতে সমাজের স্মৃতি- সমাজের সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য -বিকাশ দেখা যায়। বন্ধগুহায় বাস করিয়া আমি বুদ্ধিবলে রসায়নতত্ত্বের সাহায্যে কোনো মতে অক্সিজেন গ্যাস নির্মাণ করিয়া কিছু কাল প্ৰাণধারণ করিয়া থাকিতেও পারি, কিন্তু মুক্ত বায়ুতে যে চিরপ্রবাহিত প্ৰাণ, চিরপ্রবাহিত স্মৃতি, চিরপ্রবাহিত স্বাস্থ্য ও আনন্দ আছে তাহা তো বুদ্ধিবলে গডিয়া তুলিতে পারি না। সংকীর্ণতা ও বৃহত্ত্বের মধ্যে যে কেবল মাত্র কম ও বেশি লইয়া প্ৰভেদ তাহা নহে, তাহার আনুষঙ্গিক ফলাফলের প্রভেদই গুরুতর। ধর্মের মধ্যে সেই অত্যন্ত বৃহত্ত্ব আছে, যাহাতে সমস্ত জাতি একত্রে বাস করিয়াও তাহার বায়ু দূষিত করিতে পারে না। ধর্ম অনন্ত আকাশের ন্যায়; কোটি কোটি মনুষ্য পশু পক্ষী হইতে কীট পতঙ্গ পর্যন্ত অবিশ্রাম নিশ্বাস ফেলিয়া তাহাকে কলুষিত করিতে পারে না। আর যাহাঁই আশ্রয় করে।া-না কেন, কালক্রমে তাহা দূষিত ও বিষাক্ত হইবেই। কোনোটা বা অল্প দিনে হয়, কোনোটা বা বেশি দিনে হয়। এইজন্যই বলিতেছি- মনুষ্যত্বের যে বৃহত্তর আদর্শ আছে, তাহাকে যদি উপস্থিত আবশ্যকের