পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মন্ত্রি-অভিষেক RS পূর্ব এবং পশ্চিম যদিও বিপরীত দিক তথাপি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য মানবপ্রকৃতি সম্পূর্ণ বিরোধী ধর্মাবলম্বী নহে। তাহা যদি হইত। তবে ইংরাজি শিক্ষা, ইংরাজি শাসন-প্ৰণালী এ দেশে মরুভূমিতে বীজ বপনের ন্যায় আদ্যোপােন্ত নিস্ফল হইত। বিরোধীপক্ষীয়েরা হয়তো অবিশ্বাস করিবার মৌখিক ভান করিবেন তথাপি এ কথা আমরা বলিব, যে, যদিও আমরা প্ৰাচ্য এবং তোমাদের সাহায্য ব্যতীত জাতীয় গৌরব উপাৰ্জন করিতে অক্ষম হইয়াছি তথাপি কোন অধিকার গৌরবের এবং কোন নিষেধ অপমানের তাহা আমাদের প্রাচ্য হৃদয়েও অনুভব করিতে পারি। আমাদের মানবপ্রকৃতির এতদূর পর্যন্ত বিকার হয় নাই যে, তোমরা যখন মহৎ অধিকার আমাদের হস্তে তুলিয়া দিবে তখন আমরা অসন্তুষ্ট হইব। আমাদের জাতিধর্ম সহিষ্ণুতাকে তোমরা সম্যক অসাড়তা বলিয়া ভ্ৰম করা, তাহার কারণ তোমরা আমাদের সুখদুঃখ বিরাগ-অনুরাগ-পূৰ্ণ অন্তঃকরণের মধ্যে প্রবেশ করা অনাবশ্যক জ্ঞান করিয়া আসিতেছ। যদিও আমরা দুৰ্ভাগ্যক্রমে চিরকাল যথেচ্ছাচারী শাসনতন্ত্রের মধ্যে বাস করিয়া আসিতেছি, তথাপি মানবসাধারণের অন্তনিহিত স্বাধীনতাপ্রীতির মৃত্যুঞ্জয়ী বীজ আমাদের হৃদয়ে এখনো সম্পূৰ্ণ নিজীবী হয় নাই। আর কিছু না হীেক তোমাদের নিকটে আমাদের বেদনা, আমাদের অভাব জানাইবার অধিকার আমাদের হস্তে সমর্পণ করিলে অধিকতর সুখসন্তোষের কারণ হইবে এটুকু আমরা পূর্বদিকে বাস করিয়াও এক রকম বুঝিতে পারি। অপেক্ষাকৃত পশ্চিমবাসী যোদ্ধজাতীয়দের মানসিক প্রকৃতি যে এ বিষয়ে আমাদেব হইতে কিছুমাত্ৰ পথক তাহাও মনে করিতে পারি না। অতএব দুঃখনিবেদনের স্বাধীন অধিকার পাইলে ভারতবর্ষ যে অসন্তুষ্ট হইবে ইংলন্ডবাসী ভারতহিতৈষীগণকে এরূপ গুরুতর দুশ্চিন্তা হইতে ক্ষান্ত থাকিতে অনুরোধ করিতে পারি। অথচ সন্তোষ-উদ্রেকের জন্য বেশি যে কিছু করিতে হইবে তাহাও নহে। যদি কর্তৃপক্ষেরা বলিতেন তোমরা মন্ত্রিসভায় বসিবার একেবারেই যোগ্য ন ও অতএব মিছে কানের কাছে বকিয়ে না। তাহা হইলে আমরা ধমকটি খাইয়া শুষ্কমুখে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরিয়া যাইতাম কিন্তু গোডাকার প্রধান কঠিন সমস্যার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে! তোমাদের রাজতত্তের পাৰ্থে আমাদিগকে স্থান দিয়া সম্মানিত করিয়ােছ; আরো লোক বাড়াইতে চাও। তোমাদের শাসনতন্ত্রের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো পদেও আমাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছ। আমাদের যোগ্যতার প্রতি যে তোমাদের আন্তরিক বিশ্বাস আছে তাহার সহস্র পরিচয় দিয়ােছ। তোমরা আপনা হইতে স্বেচ্ছাপূর্বক আমাদিগকে যে-সকল উচ্চ অধিকার দিয়াছ, যে উন্নতিমঞ্চে আরোপণ করিয়াছ, তাহা আমাদের পচিশ বৎসর পূর্বেকার স্বপ্নেরও অগম্য। আজ আমরা অন্তরের মধ্যে আত্মগৌরব অনুভব করিয়া আত্মবিশ্বাসের সহিত আমাদের লব্ধ অধিকার ঈষৎ বিস্তুত করিবার প্রার্থনা করিতেছি বলিয়া কেন বিমুখ হইতেছ? আমাদের মধ্যে যে যোগ্যতা আছে তাহা প্ৰমাণ করিবার অবসর তো তোমরাই দিয়াছ। আমাদের প্ৰতি তোমরা যখন জেলা শাসনের ভার দিলে তখনই আমরা নিজে জানিলাম যে আমরা শাসনভার লাইবার যোগ্য, তোমরা যখন আমাদিগকে সর্বোচ্চ বিচারাসনে স্থান দিলে তখন আমরা আপনারাই দেখিলাম আমরা সে গুরুতর কার্যভার ও উচ্চতর সম্মানের অধিকারী; তোমরা যখন ভারতীয় রাজকার্যের পরামর্শের জন্য আমাদিগকে আহবান করিলে তখন আমরা প্রমাণ পাইলাম। এই বিপুল রাজ্যচালনকার্যে আমাদের অভিজ্ঞতাও উপেক্ষণীয় নহে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে আমাদের আত্মবিশ্বাস জাগ্ৰত করিয়া, আমাদের আশা উদ্রেক করিয়া, আজ আমাদের শিক্ষা আকাঙক্ষা ও আগ্রহকে কোন মুখে নিম্বফল করিবে ? যখন প্রার্থনা করি নাই, এবং রাজশক্তির নিকট প্রার্থনা করিবার উপায় মাত্র জানিতাম না, তখন তোমরা আমাদের উচ্চ-অধিকারের ঘোষণাপত্র প্রচার করিয়াছ। কিন্তু তদনুরূপ কাৰ্য হয় নাই, তাহা তোমরাও স্বীকার করিতেছ। এবং আমরাও অনুভব করিতেছি। এক প্রকার উচ্ছঙ্খল বদ্যান্যতা আছে যাহা সহসা স্বতঃ উৎসারিত উচ্ছাসপ্রাচুর্যে মুক্তহস্ত হইয়া উঠে, কিন্তু স্বহস্তেরচিত ঋণপত্র বা প্রতিশ্রুতিলিপি দেখিলে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্ৰ মূর্তি ধারণ করে, যাহা আকস্মিক আবেগে বৃহৎ অঙ্গীকারে