পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSS রবীন্দ্র-রচনাবলী অতএব কর্মকেই চরম লক্ষা করিয়া কর্মের উপাসনা করিবে না, তাহাকে ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া পালন করিবে ! কিন্তু বরঞ্চ মুগ্ধভাবে সংসারের কর্ম-নির্বাহও ভালো, তথাপি সংসারকে উপেক্ষা করিয়া সমস্ত কম পরিহার-পূর্বক কেবলমাত্র আত্মার আনন্দসাধনের জন্য ব্ৰহ্মসম্ভোগের চেষ্টা শ্রেয়স্কর নহে। তাহ আধাত্মিক বিলাসিত, তাহা ঈশ্বরের সেবা নহে। কর্মসাধনাই একমাত্ৰ সাধনা। সংসারের উপযোগিতা, সংসারের তাৎপৰ্যই তাই। মঙ্গলকর্মসাধনেই আমাদের স্বার্থপ্রবৃত্তি-সকল ক্ষয় হইয়া আমাদের লোভ মোহ, আমাদের হৃদগত বন্ধন-সকলের মোচন হইয়া থাকে— আমাদের যে রিপুসকল মৃত্যুর মধ্যে আমাদিগকে জড়িত করিয়া রাখে সেই মৃত্যুপােশ অবিশ্রাম মঙ্গলকমের সংঘর্ষেই ছিন্ন হইয়া যায়। কর্তব্য কর্মের সাধনাই স্বাৰ্থপাশ হইতে মুক্তির সাধনা, এবং তুয়ি নানা থেতোহস্তি ন কৰ্ম্ম লিপ্যতে নরে— ইহার আর অন্যথা নাই, কমে লিপ্ত হইবে না। এমন পথ নাই । বিদ্যাঞ্চবিদ্যাঞ্চ ন্যস্তদবেদোভয়ং সহ অবিদায়া মাতৃ তীরত্ব বিদ্যয়ামৃতমশ্বতে । বিদা এবং অবিদ্যা উভয়কে যিনি একত্র করিয়া জানেন তিনি অবিদ্যা অর্থাৎ কর্ম দ্বারা মৃত্যু হইতে উত্তীণ হইয়া ব্ৰহ্মলাভের দ্বারা অমৃত প্ৰাপ্ত হন । ইহাই সংসাবধর্মের মূলমন্ত্ৰ— কর্ম এবং ব্ৰহ্ম, জীবনে উভয়ের সামঞ্জস্যসাধন কর্মের দ্বারা আমরা ব্ৰক্ষের অভ্ৰভেদী মন্দির নির্মাণ করিতে থাকিব, ব্ৰহ্ম সেই মন্দির পবিপূৰ্ণ করিয়া বিরাজ করিতে থাকিবেন । নহিলে কিসের জন্য আমরা ইন্দ্ৰিয়গ্রাম পাইয়াছি— কেন এই পেশী, এই স্নায়ু, এই বাহুবল, এই বুদ্ধিবৃত্তি— কেন এই স্নেহ প্ৰেম দয়া- কেন এই বিচিত্র সংসার ? ইহার কি কোনো অর্থ নাই ? ইহ কি সমস্তই অনার্থের হেতু ? ব্ৰহ্ম হইতে সংসারকে বিচ্ছিন্ন করিয়া জানিলেই তাহা অনার্থের নিদান হইয়া উঠে এবং সংসার হইতে ব্ৰহ্মকে দূরে রাখিয়া তাহাকে একাকী সম্ভোগ করিতে চেষ্টা করিলেই আমরা আধ্যাত্মিক স্বার্থপরতায় নিমগ্ন হইয়া জীবনের বিচিত্র। সার্থকতা হইতে ভ্ৰষ্ট হই । পিতা আমাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়াছেন, সেখানকার নিয়ম এবং কর্তব্য সর্বথা সুখজনক নহে। সেই দুঃখের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য বালক পিতৃগৃহে পালাইয়া আনন্দলাভ করিতে চায়। সে বোঝে না বিদ্যালয়ে তাহার কী প্রয়োজন— সেখান হইতে পলায়নকেই সে মুক্তি বলিয়া জ্ঞান করে, কারণ পলায়নে আনন্দ আছে। মনোযোগের সহিত বিদ্যা সম্পন্ন করিয়া বিদ্যালয় হইতে মুক্তিলাভের যে আনন্দ তাহা সে জানে না। কিন্তু সুছাত্র প্রথমে পিতার স্নেহ সর্বদা স্মরণ করিয়া বিদ্যাশিক্ষার দুঃখকে গণা করে না, পরে তাহার সহিত বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রসর হইবার আনন্দ ও যুক্ত হয়, অবশেষে কৃতকার্য হইয়া মুক্তিলাভের আনন্দে সে ধন্য হইয়া থাকে { যিনি আমাদিগকে সংসারে প্রেরণ করিয়াছেন, সংসারবিদ্যালয়কে অবিশ্বাস করিয়া তাহাকে যেন সন্দেহ না করি।- এখানকার দুঃখকাঠিন্য বিনীতভাবে গ্রহণ করিয়া, এখানকার কর্তব্য একান্তচিত্তে পালন করিয়া, পরিপূর্ণ জীবনের মধ্যে ব্ৰহ্মামৃত লাভের সার্থকতা যেন অনুভব করি। ঈশ্বরকে সর্বত্র বিরাজমান জানিয়া সংসারের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করিয়া যে মুক্তি তাহাই মুক্তি। সংসারকে অপমানপূর্বক পলায়নে যে মুক্তি তাহা মুক্তির বিড়ম্বনা, তাহা একজাতীয় স্বার্থপরতা। সকল স্বার্থপরতার চূড়ান্ত এই আধ্যাত্মিক স্বার্থপরতা। কারণ, সংসারের মধ্যে এমন একটি অপূর্ব কৌশল আছে যে, স্বার্থসাধন করিতে গেলেও পদে পদে স্বাৰ্থত্যাগ করিতে হয়। সংসারে পরের দিকে একেবারে না তাকাইলে নিজের কার্যের ব্যাঘাত ঘটে। নীেক যেমন গুণ দিয়া টানে তেমনি সংসারের স্বার্থবিন্ধন আমাদিগকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সর্বদাই প্রতিকুল স্রোত বাহিয়া নিজের দিক হইতে পরের দিকে আকর্ষণ করিতে থাকে। আমাদের স্বাৰ্থ ক্রমশই আমাদের সন্তানের স্বাৰ্থ, পরিবারের স্বাৰ্থ, প্রতিবেশীর স্বাৰ্থ, স্বদেশের স্বাৰ্থ এবং সর্বজনের স্বার্থে অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যাপ্ত হইতে থাকে। কিন্তু যাহারা সংসারের দুঃখ শোক দারিদ্র্য হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রলোভনে আধ্যাত্মিক