পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>(?や রবীন্দ্র-রচনাবলী অপেক্ষা প্রিয়তর আর কিছুই নাই। অতএব পরমাত্মাকে যে কেবল জ্ঞানের দ্বারা জানিব তাদেতৎ সত্যং, তাহা নহে; তাহাকে হৃদয়ের দ্বারা অনুভব করিব তদস্মৃতং। তঁহাকে সকলের অপেক্ষা অধিক বলিয়া জানিব, এবং সকলের অপেক্ষা অধিক বলিয়া শ্ৰীতি করিব। জ্ঞান ও প্ৰেমাসমেত আত্মাকে ব্ৰহ্মে সমৰ্পণ করার সাধনাই ব্ৰাহ্মধর্মের সাধনা। তদ্ভাবগতেন চেতসা এই সাধনা করিতে হইবে; ইহা নীরস তত্ত্বজ্ঞান নহে, ইহা ভক্তিপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম। উপনিষদের ঋষি যে জীবাত্মামাত্রেরই নিকট পরমাত্মাকে সর্বাপেক্ষা প্রীতিজনক বলিতেছেন তাহার অর্থ কী? যদি তাহাই হইবে। তবে আমরা তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া ভ্ৰাম্যমাণ হই কেন ? একটি দৃষ্টাম্ভ-দ্বারা ইহার অর্থ বুঝাইতে ইচ্ছা করি। কোনো রসজ্ঞ ব্যক্তি যখন বলেন কাব্যরসাবতারণায় বাল্মীকি শ্রেষ্ঠ কবি, তখন এ কথা বুঝিলে চলিবে না যে, কেবল তাহারই নিকট বাল্মীকির কাব্যরস সর্বাপেক্ষা উপাদেয়। তিনি বলেন সকল পাঠকের পক্ষেই এই কাব্যরস সর্বশ্রেষ্ঠ- ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতি। কিন্তু কোনো অশিক্ষিত গ্ৰাম্য জনপদ বাল্মীকির কাব্য অপেক্ষা যদি স্থানীয় কোনো পাচলি গানে অধিক সুখ অনুভব করে তবে তাহার কারণ তাহার অজ্ঞতামাত্র। সে লোক অশিক্ষাবশত বাল্মীকির কাব্য যে কী তাহা জানে না এবং সেই কাব্যের রস যেখানে, অনভিজ্ঞতাবশত , সেখানে সে প্ৰবেশলাভ করিতে পারে না- কিন্তু তাহার অশিক্ষা বাধা দূর করিয়া দিবামাত্র যখনই সে বাল্মীকির কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবে তখনই সে স্বভাবতই মানবপ্রকৃতির নিজগুণেই গ্ৰাম্য পাচলি অপেক্ষা বাল্মীকির কাব্যকে রমণীয় বলিয়া জ্ঞান করিবে। তেমনি যে ঋষি ব্ৰহ্মের অমৃত্যরস আস্বাদন করিয়াছেন, যিনি তঁহাকে পৃথিবীর অন্য সকল হইতেই প্ৰিয় বলিয়া জানিয়াছেন, তিনি ইহা সহজেই বুঝিয়াছেন যে, ব্ৰহ্ম স্বভাবতই আত্মার পক্ষে সর্বাপেক্ষা প্রতিদায়ক- ব্রহ্মের প্রকৃত পরিচয় পাইবামাত্র আত্মা স্বভাবতই তঁহাকে পুত্র বিত্ত ও অন্য সকল হইতেই প্ৰিয়তম বলিয়া বরণ করে। ব্ৰহ্মের সহিত এই পরিচয় যে কেবল আত্মার আনন্দ-সাধনের জন্য তাহা নহে, সংসারযাত্রার পক্ষেও তােহা না হইলে নয়। ব্ৰহ্মকে যে ব্যক্তি বৃহৎ বলিয়া না জানিয়া সংসারকেই বৃহৎ বলিয়া জানে, সংসারযাত্রা সে সহজে নির্বাহ করিতে পারে না- সংসার তাহাকে রাক্ষসের ন্যায় গ্ৰাস করিয়া নিজের জঠরানলে দগ্ধ করিতে থাকে। এইজন্য ঈশোপনিষদে লিখিত হইয়াছে— ঈশাবাস্যমিদং সৰ্ববং যৎকিঞ্চি জগত্যাং জগৎ ঈশ্বরের দ্বারা এই জগতের সমস্ত যাহা কিছু আচ্ছন্ন জানিবে এবং— তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনং তাহার দ্বারা যাহা দত্ত, যাহা কিছু তিনি দিতেছেন, তাহাঁই ভোগ করিবে, পরের ধনে লোভ করিবে না। সংসারযাত্রার এই মন্ত্র। ঈশ্বরকে সর্বত্র দর্শন করিবে, ঈশ্বরের দত্ত আনন্দ-উপকরণ উপভোগ করিবে, লোভের দ্বারা পর্যকে পীড়িত করিবে না। যে ব্যক্তি ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত সংসারকে আচ্ছন্ন দেখে সংসার তাহার নিকট একমাত্র মুখ্যবস্তু নহে। সে যাহা ভোগ করে তাহা ঈশ্বরের দান বলিয়া ভোগ করে- সেই ভোগে সে ধর্মের সীমা লঙঘন করে না, নিজের ভোগমত্ততায় পরকে পীড়া দেয় না- সংসারকে যদি ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত না দেখি, সংসারকেই যদি একমাত্র মুখ্য লক্ষ্য বলিয়া জানি, তবে সংসারসুখের জন্য আমাদের লোভের অন্ত থাকে না, তবে প্রত্যেক তুচ্ছ বস্তুর জন্য হানাহানি কাড়াকড়ি পড়িয়া যায়, দুঃখ হলাহল মথিত হইয়া উঠে। এইজন্য সংসারীকে একান্ত নিষ্ঠার সহিত সর্বব্যাপী ব্ৰহ্মকে অবলম্বন করিয়া থাকিতে হইবেকারণ, সংসারকে ব্ৰহ্মের দ্বারা বেষ্টিত জানিলে এবং সংসারের সমস্ত ভোগ ব্ৰহ্মের দান বলিয়া জানিলে তবেই কল্যাণের সহিত সংসারযাত্রা-নির্বাহ সম্ভব হয়।