পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S (br রবীন্দ্র-রচনাবলী কারণ পলায়নে আনন্দ আছে! মনোযোগের সহিত বিদ্যা সম্পন্ন বিদ্যালয় হইতে মুক্তিলাভের যে আনন্দ তাহা সে জানে না। কিন্তু সুছাত্র প্রথমে পিতার স্নেহ সর্বদা স্মরণ করিয়া বিদ্যাশিক্ষার দুঃখকে গণ্য করে না, পরে বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রসর হইবার আনন্দে সে তৃপ্ত হয়- অবশেষে কৃতকার্য হইয়া মুক্তিলাভের আনন্দে সে ধন্য হইয়া থাকে। যিনি আমাদিগকে সংসারে প্রেরণ করিয়াছেন সংসার-বিদ্যালয়কে অবিশ্বাস করিয়া তাহাকে যেন সন্দেহ না করি।-- এখানকার দুঃখকাঠিন্য বিনীতভাবে গ্রহণ করিয়া, এখানকার কর্তব্য একান্তচিত্তে পালন করিয়া, পরিপূর্ণ জীবনের মধ্যে ব্ৰহ্মামৃত লাভের সার্থকতা যেন অনুভব করি। ঈশ্বরকে সর্বত্র বিরাজমান জানিয়া সংসারের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করিয়া যে মুক্তি তাহাই মুক্তি। সংসারকে অপমানপূর্বক পলায়নে যে মুক্তি তাহা মুক্তির বিড়ম্বনা- তাহা একজাতীয় স্বার্থপরতা। সকল স্বার্থপরতার চূড়ান্ত এই আধ্যাত্মিক স্বার্থপরতা। কারণ, সংসারের মধ্যে এমন একটি অপূর্ব কৌশল আছে যে, স্বাৰ্থ সাধন করিতে গেলেও পদে পদে স্বাৰ্থত্যাগ করিতে হয়। সংসারে পরের দিকে একেবারে না তাকাইলে নিজের কার্যের ব্যাঘাত ঘটে। নীেকা যেমন গুণ দিয়া টানে তেমনি সংসারের স্বার্থবিন্ধন আমাদিগকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সর্বদাই প্রতিকৃলি স্রোত বাহিয়া নিজের দিক হইতে পরের দিকে আকর্ষণ করিতে থাকে। আমাদের স্বার্থ ক্রমশই আমাদের সন্তানের স্বাৰ্থ, পরিবারের স্বাৰ্থ, প্রতিবেশীর স্বাৰ্থ, স্বদেশের স্বাৰ্থ এবং সৰ্ব্বজনের স্বার্থে অবশ্যম্ভাবী রূপে ব্যাপ্ত হইতে থাকে। কিন্তু র্যাহারা সংসারের দুঃখ শোক দারিদ্র্য হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রলোভনে আধ্যাত্মিক বিলাসিতায় নিমগ্ন হন তাহদের স্বার্থপরতা সর্বপ্রকার আঘাত হইতে সুরক্ষিত হইয়া সুদৃঢ় হইয়া উঠে। বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল বৃক্ষ হইতে রস আকর্ষণ করিয়া পরিপক্ক হইয়া উঠে। যতই সে পরিপক্ক হইতে থাকে ততই বৃক্ষের সহিত তাহার বুস্তবন্ধন শিথিল হইয়া আসে- অবশেষে তাহার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হইয়া উঠিলে বৃক্ষ হইতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হইয়া বীজকে সার্থক কবিয়া তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হইতে সেইরূপ বিচিত্র রস আকর্ষণ করি— মনে হইতে পারে তাহাতে সংসারের সহিত আমাদের সম্বন্ধ ক্ৰমেই দৃঢ় হইবে- কিন্তু তােহা নহে- আত্মার যথার্থ পরিণতি হইলে বন্ধন আপনি শিথিল হইয়া আসে। ফলেব সহিত আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতন; রস-নির্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত। আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ করিয়া বিচারপূর্বক সংসার হইতে রস গ্রহণ ও বর্জন করিতে পারিলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সেই সঙ্গে আহ্বার সফলতা সম্পন্ন হইলে সংসারের কল্যাণবন্ধন সহজেই শিথিল হইয়া আসে। অতএব ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত আচ্ছন্ন জানিয়া সংসারকে তেন তাক্তেন ভুঞ্জ থাঃ, তাহার দত্ত সুখসমৃদ্ধির দ্বারা ভোগ করিবে- সংসারকে শেষ পরিণাম বলিয়া ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে না। অপর পক্ষে সংসারের বৃস্তবন্ধন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার মঙ্গলরাস হইতে আত্মাকে বঞ্চিত করিবে না। ঈশ্বর এই সংসারবুক্ষের সহস্ৰ তন্তুর মধ্য দিয়া আমাদের আত্মায় কল্যাণরস প্রেরণ করেন; এই জীবিধারায়িতা বিপুল বনস্পতি হইতে দম্ভভরে পৃথক হইয়া নিজের রস নিজে জোগাইবার ক্ষমতা আমাদের হস্তে নাই ; কোনো সীতাকে অস্বীকার করিয়া আমাদের নিস্তার নাই ; মত্ততার বিহবলতায় মাতাল বিশ্বসংসাবকে নগণ্য করিয়া যে অন্ধ আনন্দ উপভোগ করে সে আনন্দের শ্রেয়স্করতা নাই। বিদ্যা এবং অবিদ্যা, সৎ এবং অসৎ, ব্ৰহ্ম এবং সংসার, উভয়কেই স্বীকার করিতে হইবে। দুঃখের হাত এড়াইবার জন্য কর্তব্যবন্ধন ছেদন করিবার অভিপ্ৰায়ে সংসারকে একেবারেই “না” করিয়া দিয়া একাকী আনন্দ সম্ভোগে প্ৰবৃত্ত হওয়া একজাতীয় প্ৰমত্ততা। সত্যের এক দিককে উপেক্ষা করিলে অপর দিকও অসত্য হইয়া উঠে। ঈশ্বরের আদেশপালনকে যে অস্বীকার করে, সে মুখে যাহাই বলুক, ঈশ্বরকে সম্পূৰ্ণ স্বীকার করে না। বরঞ্চ ঈশ্বরকে মুখে অস্বীকার করিয়া যে ব্যক্তি মনুষ্যের প্রতি কর্তব্যানুষ্ঠান করে সে কঠিন কর্মের দ্বারা ঈশ্বরকে স্বীকার করিয়া থাকে। জ্ঞানে এবং ভোগে এবং কর্মে ব্ৰহ্মাকে স্বীকার করিলেই তাহাকে সম্পূৰ্ণভাবে স্বীকার করা হয়। সেইরূপ সৰ্বাঙ্গীণভাবে ব্ৰহ্মাকে উপলব্ধি করিবার একমাত্র স্থান এই সংসার- আমাদের এই কর্মক্ষেত্ৰ;