পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঔপনিষদ ব্ৰহ্মা Sy &ኃ(፩ সত্য হইতে স্থলিত হইবে না, ধর্ম হইতে স্বলিত হইবে না, কল্যাণ হইতে স্বলিত হইবে না, মহত্ত্ব হইতে স্মৃলিত হইবে না। ইহা যাহার অনুশাসন তিনিই ওঁ । অনেকে বলেন, দুর্বল মানবপ্রকৃতির সর্বপ্রকার চরিতার্থতা আমরা ঈশ্বরে পাইতে চাই; আমাদের প্রেম কেবল জ্ঞানে ও ধ্যানে পরিতৃপ্ত হয় না, সেবা করিতে চায়, আমাদের প্রকৃতির। সেই স্বাভাবিক আকাঙক্ষা চরিতার্থ করিবার জন্য আমরা ঈশ্বরকে মূর্তিতে বদ্ধ করিয়া তাহাকে অশন বসন ভূষণ উপহারে পূজা করিয়া থাকি। এ কথা সত্য যে, ব্ৰহ্মের মধ্যে আমরা মানবপ্রকৃতির চরম চরিতার্থতা অন্বেষণ করি; কেবল ভক্তি ও জ্ঞানের দ্বারা সেই চরিতার্থতা লাভ হইতে পারে না, সেইজন্যই শাস্ত্ৰে গৃহস্থকে ব্রহ্মনিষ্ঠ ও ব্ৰহ্মজ্ঞানী হইতে বলিয়াছেন এবং সেইসঙ্গে বলিয়াছেন, গহী যে যে কর্মকরবেন তাহ ব্ৰহ্মাকে সমর্পণ করিবেন। সংসারের সমস্ত কর্তব্যপালনই ব্ৰহ্মের সেবা। যদি প্রতিমাকে অন্নবস্ত্ৰ পুষ্পচন্দন দান করিয়া আমরা দেবসেবার আকাঙক্ষণ চরিতার্থ করি তবে তাহাতে আমাদের কর্মের মহত্ত্ব লাভ না হইয়া ঠিক তাহার বিপরীত হয়। ব্ৰহ্মজ্ঞানে আমাদিগকে সকল জ্ঞানের চরিতার্থতার দিকে লইয়া যায়, ব্ৰহ্মের প্রতি প্রীতি আমাদিগকে পুত্ৰগ্ৰীতি ও অন্য সকল প্রীতির পরম পরিতৃপ্তিতে লইয়া যায়, এবং ব্রহ্মের কর্মও সেইরূপ আমাদের শুভ চেষ্টাকে চরম মহত্ত্ব ও ঔদার্যের অভিমুখে আকর্ষণ করে। আমাদের জ্ঞান প্ৰেম ও কর্মের এইরূপ মহত্ত্বসাধনের জন্যই মনু গৃহীকে ব্ৰহ্মপরায়ণ হইতে উপদেশ দিয়াছেন। মানবপ্রকৃতির যথার্থ চরিতার্থতা তাহাতেই।- ভোগে নহে, খেলায় নহে। প্ৰতিমাকে স্নান করাইয়া, বস্ত্র পরাইয়া, অন্ন নিবেদন করিয়া, আমাদের কর্মচেষ্টার কোনো মহৎ পরিতৃপ্তি হইতেই পারে না; তাহাতে আমাদের কর্তব্যের আদর্শকে তুচ্ছ ও সংকীর্ণ করিয়া আনে। ভক্তি ও প্রীতির উদারতা অনুসারে কর্মেরও উদারতা ঘটিয়া থাকে। পরিবারের প্রতি যাহার যে পরিমাণে প্রীতি সেই পরিবারের জন্য সেই পরিমাণে প্ৰাণপাত করিয়া থাকে। দেশের প্রতি যাহার। ভক্তি, দেশের সর্বপ্রকার দৈন্য ও কলঙ্ক -মোচনের জন্য বিবিধ দুরূহ চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়া সে আপন ভক্তির স্বাভাবিক চরিতার্থতা সাধন করিয়া থাকে। ব্রহ্মের প্রতি যাহার গভীর নিষ্ঠা, সে পরিবারের প্রতি, প্রতিবেশীর প্রতি, দেশের প্রতি, সকলের প্রতি মঙ্গলচেষ্টা নিয়োগ করিয়া ভক্তিবৃত্তিকে সফলতা দান করে। দীনকে বস্ত্ৰদান, ক্ষুধিতকে অন্নদান ইহাতেই আমাদের সেবা চেষ্টার সার্থকতা। প্রতিমার সম্মুখে অন্ন বস্ত্ৰ উপহরণ করা ক্রীড়ামাত্র, তাহ কর্ম নহে; তাহা ভক্তিবৃত্তির মোহাচ্ছন্ন বিলাসমাত্র, তাহা ভক্তিবৃত্তির সচেষ্ট সাধনা নহে! এই খেলায় যদি আমাদের মুগ্ধ হৃদয়ের কোনো সুখসাধন হয় তবে সে তো আমাদের আত্মসুখ, আমাদের আত্মসেবা, তাহাতে দেবতার কর্মসাধন হয় না। আমাদের জীবনের প্রত্যেক ইচ্ছাকৃত কর্ম নিজের সুখের জন্য না করিয়া ঈশ্বরের উদ্দেশে করা এবং তাহতেই সুখানুভব করা দেবসেবার উচ্চ আদর্শ। সেই আদর্শকে রক্ষা করিতে হইলে জড় আদর্শকে পরিত্যাগ করিতে হইবে। সন্তাজ্ঞান দুরূহ, প্রকৃত নিষ্ঠা দুরূহ, মহৎ কর্মানুষ্ঠান দুরূহ সন্দেহ নাই, তাই বলিয়া তাহাকে লঘু করিয়া, ব্যর্থ করিয়া, মিথ্যা করিয়া, মনুষ্যত্বের অবমাননা করিয়া আমরা কী ফল লাভ করিয়াছি? কর্তব্যকে খর্ব করিবার অভিপ্ৰায়ে, জ্ঞান ভক্তি কর্মকে, মানবপ্রকৃতির সবোচ্চ শিখরকে কয়েক খণ্ড মৃৎপিণ্ডে পরিণত করিয়া খেলা করিতে করিতে আমরা কোনখানে আসিয়া উপনীত হইয়াছি! আমরা নিজেকে অক্ষম অশক্ত নিকৃষ্ট অধিকারী বলিয়া স্বীকার করিয়া নিশ্চেষ্ট জড়তুকে আনন্দে বরণ করিয়া লইয়াছি। আমরা অকুষ্ঠিত স্বরে নিজেকে আধ্যাত্মিক শিশু বলিয়া প্রচার করি, এবং সর্বপ্রকার মনুষোচিত কঠিন সাধনা ও মহৎ প্ৰয়াস হইতে নিষ্কৃতি, জ্ঞানীর নিকট হইতে মাৰ্জনা ও ঈশ্বরের নিকট হইতে প্রশ্রয় প্রত্যাশা-পূর্বক নিদ্রা ক্রীড়া ও উচ্চস্থল কল্পনার দ্বারা সুখলালিত হইয়া নিস্তেজ নিবীৰ্য হইতে থাকি; যুক্তিকে পঙ্গু করিয়া, ভক্তিকে অন্ধ করিয়া, আত্মপ্রত্যয়কে আচ্ছন্ন করিয়া, ব্ৰহ্মকে চিন্তা ও চেষ্টা হইতে দূরীভূত করিয়া হৃদয় মন আত্মার মধ্যে আলস্য এবং পরাধীনতার সহস্ৰবিধ বীজ বপন করিয়া, আমরা জাতীয় দুৰ্গতির শেষ সোপানে আসিয়া অবতীর্ণ হইয়াছি। অদ্য আমরা ভয়ে ভীত, দীনতায় অবনত, শোক তাপে জর্জর। আমরা বিচ্ছিন্ন, বিধ্বস্ত, হীনবল। আমাদের বাহিরে লাঞ্ছনা,