পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬

আলোচনা ডুব দেওয়া ছোটো বড়ো ডুবিয়া যাওয়া কথাটা সচরাচর ব্যবহার হইয়া থাকে। কিন্তু ডুবিয়া মরিবার ক্ষমতা ও অধিকার কয়জন লোকেরই বা আছে! কথাটার প্রকৃত ভােবই বা কে জানে!! কবিরা, ভাবুকেরা, ভক্তেরা কেবল বলেন ডুবিয়া যাও, ইতর লোকেরা চারিদিকে চাহিয়া কঠিন মাটিতে পা দিয়া অবাক হইয়া বলে, ডুবিব কোন খানে : ডুবিবার স্থান কোথায় । জলাশয় ছাড়া যখন আর কিছুতে মগ্ন হইবার কথা হয়, তখন লোকে সেটাকে অলংকার বলিয়া গ্ৰহণ করে- সেই জনা সে কথা শুনিয়াও শোনে না, মুখে উচ্চারণ করিয়াও বোঝে না, এবং ও-বিষয়ের স্পষ্ট একটা ভাব মনে আনা নিতান্ত অনাবশ্যক মনে করে। কিন্তু আমি বলিতেছি কি ও শব্দটাকে অলংকার বলিয়া নাই মনে করিলাম; মনে করা যাক-না কেন, যাহা বলা হইতেছে ঠিক তাহাই বুঝাইতেছে! সকলে নিশ্চিন্ত হইয়া বলিতেছেন, “আমরা তো আর জলে পড়ি নাই”, কিন্তু যখন কাপড় ভিজিবাব আশু বিপদের কোনো আশঙ্কা নাই তখন একবার মনেই করা যাক-না কেন যে “হা, আমরা জলেই পডিয়ছি”। দেখি-না, কোথায় যাওয়া যায়! এ জগতের সকল বস্তুরই দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও বেধি এই তিন প্রকারের আয়তন দেখা যায়। কিন্তু এই-সকল আয়তনের অতীত আর-এক প্রকার আয়তন তাহদের আছে, তাহাকে কী বলিব খুজিয়া পাইতেছি না। তাহা অসীমােয়তনতা, বা আয়তনের অসীম অভাব। একটি বালুকণাকে আমরা যদি জড়ভাবে দেখিতে পাই, তাহা কতকগুলি পরমাণুর সমষ্টি কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই! তাহাকে কতকগুলি পরমাণুর সমষ্টি বলিলেই কি তাহার সমস্ত নিঃশেষে বলা হইল, তাহার। আর কিছুই বাকি রহিল না। তাহা কি অনন্ত জ্ঞানের সমষ্টি নহে, অনন্ত ইতিহাস অর্থাৎ অনন্ত সময়ের সমষ্টি নহে! তাহার মধ্যে যতই প্ৰবেশ কর ততই প্ৰবেশ করা যায় না। কি! তাহার বিষয় জানিয়া শেষ করিবার জো নাই- যতই জান ততই আরো জানার আবশাক হয়- জানিয়া জানিয়া অবশেষে যখন শ্ৰান্ত হইয়া সমুদয় জ্ঞানশৃঙ্খলকে অতি বৃহৎ স্তুপাকৃতি কবিয়া তুলা গেল তখনো দেখা গেল বালির শেষ হইল না। অতএব নিতান্ত জড় ভাবে না দেখিয়া মানসিক ভাবে দেখিলে বালুকণার আকার আয়তন কোথায় অদৃশ্য হইয়া যায়, জানা যায় যে তাহা অসীম ! আমরা যাহাকে সচরাচর ক্ষুদ্রতা বা বৃহত্ত্ব বলি, তাহা কোনো কাজের কথা নহে। আমাদের চক্ষু যদি অণুবীক্ষণের মতো হইত। তাহা হইলেই এখন যাহাকে ক্ষুদ্র দেখিতেছি, তখন তাহাকেই অতিশয় বৃহৎ দেখিতাম , এই অণুবীক্ষণতা-শক্তি কল্পনায় যতই বাড়াইতে ইচ্ছা কর ততই বাড়িতে পারে। অত গোলে কাজ কী, পরমাণুর বিভাজ্যতার তো আর কোথাও শেষ নাই; অতএব একটি বালুকণার মধ্যে অনন্ত পরমাণু আছে, একটি পর্বতের মধ্যেও অনন্ত পরমাণু আছে, ছোটাে বড়ো আর কোথায় রহিল। একটি পর্বতও। যা, পর্বতের প্রতোক ক্ষুদ্রতম অংশও তাই; কেহই ছোটাে নহে, কেহই বড়ো নহে, কেহই অংশ নহে, সকলেই সমান, বালুকণা কেবল যে জ্ঞেয়তায় অসীম, দেশে অসীম, তাহা নহে; তাহা কালেও অসীম, তাহারই মধ্যে তাহার অনন্ত ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান একত্রে বিরাজ করিতেছে। তাহাকে বিস্তার করিলে দেশেও তাহার শেষ পাওয়া যায় না, তাহাকে বিস্তার করিলে কালেও তাহার শেষ