পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

R\o রবীন্দ্র-রচনাবলী এইখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলিবার ইচ্ছা হইতেছে, এই বেলা সেই কথাটা বলিয়া লই, পুনশ্চ পূর্বকথা উত্থাপন করা যাইবে। অনেক লোক আছেন তাহারা কথাবার্তাতেই কি আর কবিতাতেই কি, তুলনা বরদাস্ত করিতে পারেন না। তুলনাকে তাহারা নিতান্ত একটা ঘরগড়া মিথ্যারূপে দেখেন; নিতান্ত অনুগ্রহপূর্বক ওটাকে তাহারা মানিয়া লন মাত্র। তাহারা বলেন, যেটা যাহা সেটাকে তাঁহাই বলে, সেটাকে আবার আর একটা বলিলে তাহাকে একটা অলংকার বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি, কিন্তু তাহাকে সীতা বলিয়া গ্ৰহণ করিতে পারি না। ইহারা কঠিন নৈয়ায়িক লোক, ন্যায়শাস্ত্ৰ অনুসারে সকল কথা বাজাইয়া লন, কবিতার তুলনা উপমা প্ৰভুক্তি নায়শাস্ত্রের নিকট যাচাই কবিয়া তবে গ্রহণ করেন। অতএব ইহাদের কাছে শাস্ত্ৰ অনুসারেই কথা কহা যাক। জগৎসংসারে কোন জিনিসটা একেবারে স্বতন্ত্র, কোন জিনিসটা এত বড়ো প্রতাপান্বিত যে কোনো কিছুর সহিত কোনো সম্পর্ক বাখে না ? জড়বুদ্ধিরা সকল জিনিসকেই পৃথক করিয়া দেখে, তাহাদের কাছে সবই স্ব-স্ব প্রধান। বৃদ্ধির যতই উন্নতি হয় ততই সে ঐক্য দেখিতে পায়। বিজ্ঞান বলো, দর্শন বলো, ক্রমাগত একের প্রতি ধাবমান হইতেছে, সহজ চক্ষে যাহাঁদের মধ্যে আকাশ পাতাল, তাহারাও অভেদাত্মা হইয়া দাড়াইতেছে ; এ বিশ্বরাজো বিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক ঐক্য, দর্শন দার্শনিক ঐক্য দেখাইতেছে, কবিতা কী অপরাধ করিল ? তাহাব কাজ জগতের সৌন্দর্যগত ভাবগত ঐক্য বাহির করা। তুলনার সাহায্যে কবিতা তাহাঁই করে, তাহাকে যদি তুমি সত্যু বলিয়া শিরোধার্য না কর, কল্পনার ছেলেখেলা মাত্ৰ মনে কর, তাহা হইলে কবিতাকে অনায় অপমান করা হয়। কবিতা যখন বলে, তারাগুলি আকাশে চলিতে চলিতে গান গাহিতেছে, যথা There's not the Smallest orb which thou beholdest But in his motion like an angel sings. তখন তুমি অনুগ্রহপূর্বক শুনিয়া গিয়া কবিকে নিতান্তই বাধিত কর। মনে মনে বলিতে থােক, তাহারা চলিতেছে ইহা স্বীকার কবি, কিন্তু কোথায় চলা আর কোথায় গান গাওয়া! চলাটা চোখে দেখিবার বিষয় আর গান গাওয়াটা কানে শুনিবার- তবে অলংকারের হিসাবে মন্দ হয় নাই। কিন্তু হে তর্কবাচস্পতি, বিজ্ঞান যখন বলে বাতাসের তরঙ্গলীলাই ধ্বনি, তখন তুমি কেন বিনা বাকাব্যয়ে অমানবদনে কথাটাকে গলাধঃকরণ করিয়া ফেল! কোথায় বাতাসের বিশেষ একরূপ কম্পন-নামক গতি, আর কোথায় আমাদের শব্দ শুনিতে পাওয়া! সচরাচর বাতাসের গতি আমাদের স্পর্শের বিষয়, কিন্তু শব্দে ও স্পর্শে যে ভাই-ভাই সম্পর্ক ইহা কে জানিত ! বৈজ্ঞানিকেরা পরীক্ষা করিয়া জানিয়াছেন, কবিরা হৃদয়ের ভিতর হইতে জানিতেন। কবিরা জানিতেন, হৃদয়ের মধ্যে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে শব্দ স্পর্শ ঘাণ সমস্ত একাকার হইয়া যায়। তাহারা যতক্ষণ বাহিরে থাকে ততক্ষণ স্বতন্ত্র। তাহারা নানা দিক হইতে নানা দ্রব্য স্বতন্ত্র ভাবে উপাৰ্জন করিয়া আনে, কিন্তু হৃদয়ের অন্তঃপুরের মধ্যে সমস্তই একত্রে জমা করিয়া রাখে এবং এমনি গলাগলি করিয়া থাকে যে কোনটি যে কে চেনা যায় না। সেখানে গন্ধকে স্পশ্য বলিতে আপত্তি নাই, রূপকে গান বলিতে বাধে না। পূর্বেই তো বলা হইয়াছে, যেখানে গভীর সেখানে সমস্তই একাকার। সেখানে হাসিও যা কান্নাও তা, সেখানে সুখমতি বা দুঃখমিতি বা। জ্ঞানে যাহারা বর্বর তাহারা যেমন জগতে বৈজ্ঞানিক ঐক্য দার্শনিক ঐক্য দেখিতেও পায় না, বুঝিতেও পারে না, তেমনি ভাবে যাহারা বর্বর তাহারা কবিতাগত ঐক্য দেখিতেও পায় না, বুঝিতেও পারে না। ইংরাজি সাহিত্য পড়িয়া আমার মনে হয় কবিতায় তুলনা ক্রমেই উন্নতিলাভ করিতেছে, যাহাঁদের মধ্যে ঐক্য সহজে দেখা যায় না। তাহদের ঐক্যও বাহির হইয়া পড়িতেছে। কবিতা বিজ্ঞান ও দর্শন ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া চলিতেছে, কিন্তু একই জায়গায় আসিয়া মিলিবে ও আর কখনো বিচ্ছেদ হইবে না।