পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ठ6९ मठ যাহা হউক, দেখা যাইতেছে সবই একাকার হইয়া পড়ে, জগৎটা না থাকিবার মতোই হইয়া আসে ; যাহা দেখিতেছি তাহা যে তাহাঁই নহে, ইহাই ক্রমাগত মনে হয় । এইজন্যই জগৎকে কেহ কেহ মিথ্যা। বলেন। কিন্তু আর এক রকম করিয়া জগৎকে হয়তো সীতা বলা যাইতে পারে। সত্য যাহা তাহা অদৃশ্য, তাহা কখনো ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য নহে, তাহা একটা ভাব মাত্ৰ , কিন্তু ভােব আমাদের নিকট নানারূপে প্ৰকাশ পায় ভাষা আকারে, অক্ষর আকারে, বিবিধ বস্তুর বিচিত্ৰবিন্যাস আকারে। তেমনি প্রকৃত জগৎ যাহা তাহা অদৃশ্য, তাহা কেবল একটি ভােব মাত্র, সেই ভাবটি আমাদের চোখে বহির্জগৎকাপে প্ৰকাশিত হইতেছে। যেমন, যাহা পদার্থ নাহে যাহা একটি শক্তি মাত্র তাহাকেই আমরা বিচিত্র বর্ণরূপে আলোককাপে দেখিতেছি ও উত্তাপরুদ্ধপে অনুভব করিতেছি, তেমনি যাহা একটি সােতামাত্র তাহাকে আমরা বহির্জগৎরহ্মপে দেখিতেছি । একজন দেবতার কাছে হয়তো এ জগৎ একেবারেই অদৃশ্য, তাহার কাছে আকার নাই, আয়তন নাই, গন্ধ নাই, শব্দ নাই, স্পর্শ নাই, তাহার কাছে কেবল একটা জানা আছে মাত্র। একটা তুলনা দিই! তুলনাটা ঠিক না হউক একটুখানি কাছাকাছি আসে। আমার যখন বর্ণপরিচয় হয় নাই, তখন যদি আমার নিকটে একখানা বই আনিয়া দেওয়া হয়তবে সে বইয্যের প্রতোক আঁচড় আমার চক্ষে পড়ে, প্রত্যেক বৰ্ণ আলাদা আলাদা করিয়া দেখিতে পাই ও সমস্তটা অনর্থক ছেলেখেলা মনে কবি ; কিন্তু যখন পড়িতে শিখি, তখন আর অক্ষর দেখিতে পাই না। তখন বস্তুত বইটা আমার নিকটে অদৃশ্য হইয়া যায়, কিন্তু তখনি বইটা যথার্থতি আমার নিকটে বিরাজ করিতে থাকে তখন আমি যাহা দেখি তাহা দেখিতে পাই না, আর-একটা দেখিতে পাই। তখন আমি বস্তুত দেখিলাম গা-য়ে আকার ছ। (গাছ), কিন্তু তাহা না দেখিয়া দেখিলাম একটা ডালপালা-বিশিষ্ট উদ্ভিদ পদাৰ্থ ; কোথায় একটা কালো আঁচড আর কোথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ ! কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা বুঝিয়া পড়িতে পারি ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আঁচড়গুলা কি সমস্তই মিথ্যা নহে! যে বাক্তি সাদা কাগজের উপরে হিজিবিজি কাটে তাহাকে কি আমরা নিতান্ত অকমণা বলিব না। কারণ অক্ষর মিথ্যা ; আমার একরূপ অক্ষর আর-একজনের আর-একরূপ অক্ষর ; ভাষা মিথ্যা ! আমার ভাষা এক তোমার ভাষা আব-এক। আজিকার ভাষা এক কালিকার ভাষা আর-এক : এ ভাষায় বলিলেও হয় ও ভাষায় বলিলেও হয় । গাছ বলিয়া একটা আওয়াজ শুনিলে আমি মনের মধ্যে যে জিনিষটা দেখিতে পাইব, আর একজন ব্যক্তি ট্রা বলিয়া একটা আওয়াজ না শুনিলে ঠিক সে জিনিসটা মনে আনিতে পরিবে না। অতএব দেখা যাইতেছে অক্ষর ও ভাষা তুমি ঘরে গডিয়া বন্দোবস্ত করিয়া বদল কবিতে পার। কিন্তু তাহারি আশ্রিত ভাবটিকে খেয়াল অনুসারে বদল করা যায় না, তাহা ধ্রুব { জগৎকে যে আমাদের মিথা বলিয়া মনে হইতেছে, তাহার কারণ কি এমন হইতে পারে না যে, জগতের বর্ণপরিচয় আমাদের কিছুই হয় নাই! জগতের প্রতোক অক্ষর আঁচড়ের আকারে, সুতরাং মিথ্যা আকারে আমাদের চোখে পড়িতেছে! যখন আমরা বাস্তবিক জগৎকে পড়িতে পারিব তখন এ জগৎকে দেখিতে পাইব না। এ পড়া কি এক দিনে শেষ হইবে! এ বর্ণমালা কি সামানা! এ জগৎ মিথ্যা নয়, বুঝি সত্য হবে, অক্ষর আকারে শুধু লিখিত রয়েছে! অসীম হতেছে ব্যক্ত সীমা রূপ ধরি! প্রেমের শিক্ষা কিন্তু কে পড়াইবো! কে বুঝাইয়া দিবে যে জগৎ কেবল স্তুপাকৃতি কতকগুলো বস্তু নহে, উহার মধ্যে ভাব বিরাজমান ? আর কেহ নহে, প্ৰেম । জগৎকে যে যথার্থ ভালোবাসে সে কখনো মনে করিতেও পারে না জগৎ একটা নিরর্থক জড়পিণ্ড। সে ইহারই মধ্যে অসীমের ও চিরজীবনের আভাস দেখিত্বে