পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আলোচনা w©ዓ করিলাম? সঞ্চায়ের খাতায় কোন নূতন কড়িটা জমা করিলাম? কিছুক্ষণের মতো আনন্দ পাইলাম, সে তো সন্দেশ খাইলেও পাই। ততক্ষণ যদি পাজি দেখিতাম, তবে আজকেকার তারিখ বার ও কবে চন্দ্ৰগ্ৰহণ হইবে সে খবরটা জানিতে পাইতাম। বৈষয়িকেরা যাহাই বলুন-না কেন, আর কোনো উদ্দেশ্যের আবশ্যক করে না, মনে সৌন্দর্য উদ্রেক করাই যথেষ্ট মহৎ । কবিতার ইহা অপেক্ষা মহত্তর উদ্দেশ্য আর থাকিতে পারে না। সৌন্দর্য উদ্রেক করার অর্থ আর কিছু নয়- হৃদয়ের অসাড়তা অচেতনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, হৃদয়ের স্বাধীনতাক্ষেত্র প্রসারিত করিয়া দেওয়া। সে কার্যে যাহারা ব্ৰতী, তাহাদের সহিত একটি ময়রার তুলনা ঠিক খাটে না। অতএব কবিদিগকে আর কিছুই করিতে হইবে না, তাহারা কেবল সৌন্দৰ্য ফুটাইতে থাকুনজগতের সর্বত্র যে সৌন্দৰ্য আছে তাহা তাহাদের হৃদয়ের আলোকে পরিস্ফুট ও উজ্জ্বল হইয়া আমাদের চোখে পড়িতে থাকুক, তবেই আমাদের প্ৰেম জাগিয়া উঠিবে, প্ৰেম বিশ্বব্যাপী হইয়া পড়িবে। कविडी ९ ऊर् কবিরা যদি একটি তত্ত্ববিশেষকে সমূখে খাড়া করিয়া তাহারই গায়ের মাপে ছাট-ছোট কবিয়া কবিতার মেরজাই ও পায়জামা বানাইতে থাকেন, ও সেই পোশাকে সুসজ্জিত করিয়া তত্ত্বকে সমাজে ছাডিয়া দেন, তবে সে তত্ত্বগুলিকে কেমন খোকাবাবুর মতো দেখায় ও সে কাজটাও ঠিক কবির উপযুক্ত হয়। না। এক-একবার এমন দজীবৃত্তি কবিতে দোষ নাই, এবং মোটা মোটা বয়স্ক তত্ত্বেরা যদি মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান-বিশেষের সময়ে তাহদের থানধৃতি ছাডিয়া এইরূপ পোশাক পরিয়া সভায় আসিয়া উপস্থিত হন। তাহাতেও তেমন আপত্তি দেখি না! কিন্তু এই যদি প্রথা হইয়া পড়ে, কবিতাটি দেখিলেই যদি দশজনে পডিয়া তাহার খোলা ও শািস ছাড়াইয়া ফেলিয় তাহা হইতে তত্ত্বের আর্টি বাহিক করাই প্রধান কর্তব্য বিবেচনা করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ক্ৰমে এমন ফলের চাষ হইতে আরম্ভ হইবে যাহার আটিটাই সমস্ত, এবং যে-সকল ফলের মধ্যে আটিব বাহুল্য থাকিবে না শাস এবং মধুর বাসই অধিক, তাহারা নিজের আটিদরিদ্র অস্তিত্ব ও মাধুর্যরসের আধিকা লইয়া নিতান্ত লজ্জা অনুভব করিবে তখন গহনা-পরা গরবিনীকে দেখিয়া ভুবনমোহিনী রূপসীরাও ঈর্ষাদগ্ধ হইবে। তত্ত্বের বার্ধক্য তত্ত্ব অর্থাৎ জ্ঞান পুরাতন হইয়া যায়, মৃত হইয়া যায়, মিথ্যা হইয়া যায়। আজ যে জ্ঞানটি নানা উপায়ে প্রচার কবিবার আবশ্যক থাকে, কাল আর থাকে না, কাল তাহা সাধারণের সম্পত্তি হইয়া গিয়াছে। কাল যদি পুনশ্চ সে কথা উত্থাপন কবিতে যাও তবে লোকে তোমাকে মাবিতে আসে; বলে, “আমি কি জাহাজ হইতে নামিয়া আসিলাম, না। আমি কাল জন্মগ্রহণ করিয়াছি?” জ্ঞান একটু পুরাতন হইলেই তাহার পুনরুক্তি আর কাহারও সহ্য হয় না। অনেক জ্ঞান কালক্রমে লোপ পায়, পরিবর্তিত হইয়া যায়, মিথ্যা হইয়া পড়ে। এমন একদিন ছিল যখন, আমরা শব্দ যে কানেই শুনি সর্বাঙ্গ দিয়া শুনি না, এ কথাটাও নূতন সত্য ছিল। তখন এ কথাটা প্রমাণ দিয়া বুঝাইতে হইত। কিন্তু হৃদয়ের কথা চিরকাল পুরাতন এবং চিরকাল নূতন। বাল্মীকির সময়ে যে-সকল তত্ত্ব সত্য বলিয়া প্রচলিত ছিল, তাহাদের অনেকগুলি এখন মিথ্যা বলিয়া স্থির হইয়াছে, কিন্তু সেই প্রাচীন ঝষি-কবি হৃদয়ের যে চিত্ৰ দিয়াছেন তাহার কোনোটাই এখনো অপ্রচলিত হয় নাই। অতএব জ্ঞান কবিতার বিষয় নহে। কবিতা চিরযৌবনা। এই বুড়ার সহিত বিবাহ দিয়া তাহাকে অল্প বয়সে বিধবা ও অনুমূতা করা উচিত হয় না।