পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SR রবীন্দ্র-রচনাবলী ২য়। প্ৰকৃতি বলিতেছে, আমি তোমার জন্য বিস্তর কাজ করিয়া দিতেছি, আর তুমি কি তোমার নিজের জন্য কিছু করিবে না! জড়ের সহিত তোমার প্রভেদ এই যে, তোমার নিজের জন্য অনেক কাজ তোমার নিজেকেই করিতে হয়। তুমি পুরুষের মতো আহার উপাৰ্জন করিয়া আনো, তার পরে সেটাকে পাকযন্ত্রে রাধিয়া লইবার অতি কৌশলসাধা কাৰ্যভার সে আমার উপরে রহিল- তাহার জন্যে তুমি বেশি ভাবিয়ো না ? তুমি কেবল চলিবার উদাম করো, দেখিবে আমি তোমাকে চালাইয়া লইয়া যাইব । ১ম। ঠিক কথা, কিন্তু প্ৰকৃতি কখনো বলে না যে, আমি করিতেছি। আমাদের বেশির ভাগ কাজ যে প্রকৃতি সম্পন্ন করিয়া দিতেছে তাহা কি আমরা জানি ? আমাদের নিরুদ্যমে যে শতসহস্র কাজ চলিতেছে, তাহা চলিতেছে বলিয়া আমাদের চেতনাই থাকে না। এই-যে অতি কোমল বাতাস বহিতেছে, এই-যে আমার চোখের সমুখে গঙ্গার ছোটাে ছোটাে তরঙ্গগুলি মৃদু মৃদু শব্দ করিতে করিতে তটের উপরে মুহুর্মুহু লুটাইয়া পড়িতেছে, ইহারা আমার হৃদয়ের এই অতি তীব্ৰ শোক অহরহ শান্ত করিতেছে। জগতের চতুদিক হইতে আমার উপর অবিশ্রাম সাত্মনা বর্ষিত হইতেছে, অথচ আমি জানিতে পারিতেছি না, অথচ কেহই একটি সান্তনার বাকা বলিতেছে না- কেবল অলক্ষো অদৃশ্যে আমার আহত হৃদয়ের উপরে তাহদের মন্ত্রপূত হাত বুলাইয়া যাইতেছে, আহাউহুটুকুও বলিতেছে না। আমাদের চতুর্দিকবতী এই যে কাৰ্যকুশল সদাব্যস্ত ব্যক্তিগণ গুপ্তভাবে থাকে সে কেবল আমাদিগকে ভুলাইবার জন্য, আমাদিগকে জানাইবার জন্য যে আমরাই স্বাধীন। ২য়। অর্থাৎ, অধীনতা খুব প্ৰকাণ্ড হইলে তাহাকে কতকটা স্বাধীনতা বলা যাইতে পারে— কারাগার যদি মস্ত হয়, তবে তাহাকে কারাগার না বলিলেও চলে। বোধ করি, আমাদিগকে স্থায়ীরূপে অধীন রাখিবার জন্য এই উপায় অবলম্বন করা হইয়াছে। পাছে মুহুর্মাহু আমাদের চেতনা হয় যে আমরা অধীন, ও বৈরাগ্যসাধনা-দ্বারা প্রকৃতির শাসন লঙ্ঘন করিয়া স্বাধীন হইতে চেষ্টা করি, এই ভয়ে প্রকৃতি আমাদের হাত হইতে হাতকড়ি খুলিয়া লইয়া আমাদিগকে একটা বেড়া-দেওয়া জায়গায় রাখিয়া দিয়াছে। আমরা ভুলিয়া থাকি আমরা অধীনতার দ্বারা বেষ্টিত, মনে করি আমরা ছাড়া পাইয়াছি। ১ম। কিংবা এমনও হইতে পারে প্রকৃতি আমাদিগকে স্বাধীনতার শিক্ষা দিতেছেন। দেখো-না কেন, উত্তরোত্তর কেমন স্বাধীনতারই বিকাশ হইতেছে। জড় যে, সে নিজের জন্য কিছুই করিতে পারে না। উদ্ভিদ তাহার চেয়ে কতকটা উচ্চ। কারণ টিকিয়া থাকিবার জন্য খানিকটা যেন তাহার নিজের উদামের আবশ্যক, তাহাকে রস আকর্ষণ করিতে হয়, বাতাস হইতে আহার্য সংগ্ৰহ করিতে হয়। মানুষ এত বেশি স্বাধীন যে, প্রকৃতি বিস্তর প্রধান প্রধান কাজ বিশ্বাস করিয়া আমাদের নিজের হাতেই রাখিয়া দিয়াছেন। আর, স্বাধীনতা জিনিস বড়ো সামান্য নহে! জাড়ের কোনো বালাই নেই। আমরা, মানুষেরা, কী করিলে যে ভালো হইবে পদে পদে তাহা ভাবিয়া পাই না। আকুল হইয়া একবার এটা দেখিতেছি, একবার ওটা দেখিতেছি; এবং এইরূপ পরীক্ষা করিতে করিতেই আমরা শত সহস্ৰ করিয়া মারা পড়িতেছি। উত্তরোত্তর যেরূপ স্বাধীনতার বিকাশ হইয়া আসিয়াছে ইহারই যদি ক্রমিক চালনা হয়, তাহা হইলে মানুষের পর এমন জীব জন্মাইবে যাহার ক্ষুধা পাইবে না। অথচ বিবেচনাপূর্বক আহার করিতে হইবে (অনেক মানুষেরই তাহা করিতে হয়), রক্তসঞ্চালন ও পরিপাককার্য তাহার নিজের কৌশলে করিয়া লইতে হইবে (মানুষের রন্ধন-কাৰ্যও কতকটা তাঁহাই), ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার শরীরের পরিণতি সাধন করিতে হইবে- এক কথায়, তাহার। আপাদমস্তকের সমস্ত ভার তাহার নিজের হাতে পড়িবে। তাহার প্রত্যেক কার্যের ফলাফল সে অনেকটা পর্যন্ত দেখিতে পাইবে। একটি ‘কথা কহিলে আঘাতজনিত বাতাসের তরঙ্গ কত দূরে কত বিভিন্ন শক্তিরূপে রূপান্তরিত হইবে তাহা সে জানিবে, এবং তাহার সেই কথার ভাব সমাজের মধ্যে প্ৰবেশ করিয়া কত হৃদয়কে কতরূপে বিচলিত করিবে, তাহার ফল পুরুষানুক্ৰমে কত দূরে কী আকারে প্রবাহিত হইবে তাহা বুঝিতে পরিবে। ২য়। আমাদের স্বাধীনতাও আছে, অধীনতাও আছে, বোধ করি চিরকালই থাকিবে। স্বাধীনতার যেমন সাধনা আবশ্যক, অধীনতারও বোধহয় সেইরূপ সাধনা আবশ্যক। হয়তো বা উৎকর্ষপ্রাপ্ত