পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী মণ্ডলী আমরা দেখিতে পাই না। কিন্তু তাহার সেই খাদ্যাধারমণ্ডলী তাহার সঙ্গে সঙ্গে অলক্ষিত ভাবে ফিরিতেছে। যে ব্যক্তি সৌন্দর্যপ্রিয় সে তাহার দেহের মধ্যে, তার চর্মাবরণটুকুর মধ্যে বাস করে না। সে তাহার চারি দিকের তরুলতার মধ্যে আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে বাস করে। সে যেখানেই যায় চন্দ্ৰসূৰ্যময় আকাশ তাহার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে, তৃণ-পত্র-পুষ্প-ময়ী বনশ্ৰী তাহাকে ঘিরিয়া রাখে। ইহারা তাহার ইন্দ্ৰিয়ের মতো। চন্দ্ৰসূর্যের মধ্য দিয়া সে কী দেখিতে পায়; কুসুমের সৌগন্ধা ও সৌন্দর্যের সাহায্যে তাহার হৃদয়ের ক্ষুধা নিবৃত্ত হইতে থাকে। এই মণ্ডলীর বিস্তার লইয়া মানুষের ছোটােবডোতু। মনুষ্যের যে দেহ মাপিতে পারা যায় সে দেহ গড়ে প্রায় সকলেরই সমান। কিন্তু যে দেহ দেখা যায় না, মাপা যায় না, তাহার ছোটাে বড়ো সামান্য নহে! এই দেহ, এই মণ্ডলী, এই বৃহৎ দেহ, এই অবস্থাগোলক, যাহার মধ্যে আমাদের শাবক। আত্মার খাদা সঞ্চিত ছিল, ইহাই ভাঙিয়া ফেলিয়া সে পরলোকে জন্মগ্রহণ করে। মানুষ চেনা যেমন মানুষের বৃহৎ দেহটি আমরা দেখিতে পাই না, তেমনি যথার্থ মানুষ যে তাহাকেও দেখিতে পাই না। এইজনা কাহারও জীবনচরিত লেখা সম্ভব নহে। কারণ, লেখকেরা মানুষের কাজ দেখিযা তাহার জীবনচরিত লেখেন। কিন্তু যে গোটাকতক কাজ মানুষ করিয়াছে তাই তিনি দেখিতে পান, লক্ষ লক্ষ কাজ যাহা সে করে নাই তাহা তো তিনি দেখিতে পান না। আমবা তাহাব কতব, গুগল কাজের টুকরা এখােন ওখান হইতে কুড়াইয়া জোড়া দিয়া একটা জীবনচরিত খাড়া করিয়া তুলি, কিন্তু তাহাক সমগ্রটি তো দেখিতে পাই না! তাহার মধ্যস্থিত যে মহাপুরুষ অসংখ্যা অবস্থায় অসংখ্য আকার ধারণ কবিতে পারিত, তাহাকে তো দেখিতে পাই না। তাহার কাজকর্মের মধ্যে বরঞ্চ সে ঢাকা পািভয়া যায়, আমােবা কেবলমাত্ৰ উপস্থিতটুকু দেখিতে পাই; যত কাজ হইয়া গিয়াছে, যােত কাজ হইবে, এবং যত কাজ হইতে পারিত, উপস্থিত কার্যখণ্ডের সহিত তাহার যোগ দেখিতে পাই না। আমরা মুহুর্তে মুহূর্তে এক-একটা কাজ দেখিয়া সেই কাৰ্য-কারকের মুহুর্তে মুহুর্তে এক-একটা নাম দিই সেই নামের প্রভাবে তাহার ব্যক্তি-বিশেষত্ব ঘুচিয়া যায়, সে একটা সাধারণ-শ্রেণী-ভুক্ত হইয়া পড়ে, সুতরাং ভিডের মধ্যে তাহাকে হারাইয়া ফেলি। আমরা রামকে যখন খুনী বলি, তখন সে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ খুনীর সহিত এক হইয়া যায়। কিন্তু রাম-খুনী ও শ্যাম-খুনীর মধ্যে এই খুন সম্বন্ধেই এমন আকাশ পাতাল প্ৰভেদ যে উভয়কে এক নাম দিলে বুঝিবার সুবিধা হওয়া দূরে থাকুক, বুঝিবার ভ্ৰম হয়। আমরা প্ৰত্যহ আমাদের কাছের লোকদিগকে এইরূপে ভুল বুঝি। তাড়াতাডি তাহদের এক-একটা নামকরণ কবিয়া ফেলি ও নামের কৃত্রিম খোলসটার মধ্যেই সেই ব্যক্তি ঢাকা পড়িয়া যায়। অনেক সময়ে মানুষ অনুপস্থিত থাকিলেই তাহাকে ঠিক জানিতে পারি। কারণ, সকল মানুষই বৃহৎ ; বৃহৎ জিনিসকে দূর হইতে দেখিলেই তাহার সমস্তটা দেখা যায়, কিন্তু তাহার অত্যন্ত কাছে লিপ্ত থাকিয়া দেখিলে তাহার খানিকটা অংশ দেখা যায় মাত্র, সেই অংশকেই সমস্ত বলিয়া ভ্ৰম হয়। মানুষ অনুপস্থিত থাকিলে আমরা তাহার, দুই চাবি বর্তমান মুহূর্ত মাত্ৰ দেখি না, যতদিন হইতে তাহাকে জানি, ততদিনকার সমষ্টিস্বরূপে তাহাকে জানি। সুতরাং সেই জানাটাই অপেক্ষাকৃত যথার্থ। পৃথিবীর অধিবাসীরা পৃথিবীকে কেহ বলিবে উচু, কেহ বলিবে নীচু, কেহ বলিবে উচ্চ-নীচু! কিন্তু যে লোক পৃথিবী হইতে আপনাকে তফাত করিয়া সমস্ত পৃথিবীটা কল্পনা করিয়া দেখে, সে এই সামান্য উচুনীচুগুলিকে গ্রাহ্য না করিয়া বলিতে পারে যে পৃথিবী সমতল গোলক। কথাটা খাটি সত্য নহে, কিন্তু সর্বাপেক্ষা সতী । শ্রেষ্ঠ অধিকার আত্মার উপরে শ্রেষ্ঠ অধিকার কাহার জন্মিয়াছে ? যে আত্ম-বিসর্জন করিতে পারে! নাবালক যে, তাহার বিষয় আশয় সমস্তই আছে বটে, কিন্তু সে বিষয়ের উপর তাহার অধিকার নাই- কারণ, তাহার দানের