পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ऊष्• 8Գ তীর্থ। পৃথিবীতে কত কী আছে, কিন্তু মানুষ সৌন্দর্য ছাড়া এখানে এমন আর কিছু দেখে নাই, যাহা দিয়া সে তাহার স্বৰ্গ গঠন করিতে পারে। সৌন্দর্য যেন স্বর্গের জিনিস পৃথিবীতে আসিয়া পড়িয়াছে, এই জনা পৃথিবী হইতে স্বৰ্গে কিছু পাঠাইতে হইলে সৌন্দর্যকেই পাঠাইতে হয়। এইজনা সুন্দর জিনিস যখন ধ্বংস হইয়া যায়, তখন কবিরা কল্পনা করেন- দেবতারা স্বর্গের অভাব দূর করিবার জন্য উহাকে পৃথিবী হইতে চুরি করিয়া লইয়া গেলেন। এইজনা পৃথিবীতে সৌন্দর্যের উৎকর্ষ দেখিলে উহাকে স্বৰ্গচুতে বলিয়া গোজামিলন দিয়া না লইলে যেন হিসাব মিলে না। এইজনা. আজ ও ইন্দুমতী क्लिन् তাই মনে হইতেছে পৃথিবীর যে প্রান্তে স্বগের আরম্ভ, সেই প্ৰান্তটিই যেন সৌন্দর্য। সৌন্দৰ্য মাঝে না। থাকিলে যেন স্বৰ্গে মর্তে চিরবিচ্ছেদ হইত। সৌন্দর্যে স্বৰ্গে মর্তে উত্তর প্রত্যুত্তর চলে- সৌন্দর্যের মাহাত্মাই তাই, নহিলে সৌন্দর্য কিছুই নয়! স্বগের গান শঙ্খকে সমুদ্র হইতে তুলিয়া আনিলেও সে সমূদ্রের গান ভুলিতে পারে না। উহা কানের কাছে ধরো, উহা হইতে অবিশ্রাম সমুদ্রের ধ্বনি শুনিতে পাইবে। পৃথিবীর সৌন্দর্যের মর্মস্থলে তেমনি স্বর্গের গান বাজিতে থাকে। কেবল বিধির তাহা শুনিতে পায় না। পৃথিবীর পাখির গানে পাখির গানের অতীত আরেকটি গান শুনা যায়, প্ৰভাতের আলোকে প্ৰভাতের আলোক অতিক্রম করিয়া আরেকটি আলোক দেখিতে পাই, সুন্দর কবিতায় কবিতার অতীত আরেকটি সৌন্দর্যমহাদেশের তীরভূমি চােখের সম্মুখে এই অনেকটা দেখা যায় বলিয়া আমরা সৌন্দর্যকে এত ভালোবাসি। পৃথিবীর চারি দিকে দেয়াল, সৌন্দর্য তাহার বাতায়ন। পৃথিবীর আর সকলই তাহদের নিজ নিজ দেহ লইয়া আমাদের চোখের সম্মুখে আড়াল করিয়া দাড়ায়, সৌন্দর্য তাহা করে না- সৌন্দর্যের ভিতর দিয়া আমরা অনন্ত রঙ্গভূমি দেখিতে পাই!” এই সৌন্দৰ্যবাতায়নে বসিয়া আমরা সুদূর আকাশের নীলিমা দেখি, সুদূর কাননের সমীরণ স্পর্শ করি, সুদূর পুষ্পের গন্ধ পাই, স্বগের সূর্যকিরণ সেইখান হইতে আমাদের গৃহের মধ্যে প্ৰবেশ করে। আমাদের গৃহের স্বাভাবিক অন্ধকার দূর হইয়া যায়, আমাদের হৃদয়ের সঙ্কোচ চলিয়া যায়, সেই আলোকে পরস্পরের মুখ দেখিয়া আমরা পরস্পরকে ভালোবাসিতে পারি। এই বাতায়নে বসিয়া অনন্ত আকাশের জন্য আমাদের প্রাণ যেন হা হা করিতে থাকে, দুই বাহু তুলিয়া সূর্যকিরণে উড়িতে ইচ্ছা যায়, এই সৌন্দর্যের শেষ কোথায় অথবা এই সৌন্দর্যের আরম্ভ কোথায়, তাহারই অন্বেষণে সুদূর দিগন্তের অভিমুখে বাহির হইয়া পড়িতে ইচ্ছা করে, ঘরে যেন আর মন টেকে না। বাশির শব্দ শুনিলে তাই মন উদাস হইয়া যায়, দক্ষিণা বাতাসে তাই মনটাকে টানিয়া কোথায় বাহির করিয়া লইয়া যায়। সৌন্দর্যচ্ছবিতে তাই আমাদের মনে এক অসীম আকাঙক্ষা উদ্রেক করিয়া দেয়। সাডা স্বর্গে মর্তে এমনি করিয়াই কথাবার্তা হয়। সৌন্দর্যের প্রভাবে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে একটি ব্যাকুলতা উঠে, পৃথিবীর কিছুতেই সে যেন তৃপ্তি পায় না। আমাদের হৃদয়ের ভিতর হইতে যে একটি আকুল আকাঙক্ষার গান উঠে, স্বৰ্গ হইতে তাহার যেন সাড়া পাওয়া যায়।