পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ኳr রবীন্দ্র-রচনাবলী সৌন্দর্যের ধৈর্য যাহার এমন হয় না, তাহার। আজ যদি বা না হয়, কাল হইবো! আর-সকলে বলের দ্বারা অবিলম্বে নিজের ক্ষমতা বিস্তাৱ করিতে চায়, সৌন্দর্য কেবল চুপ করিয়া দাড়াইয়া থাকে, আর কিছুই করে না। সৌন্দর্যের কী অসামান্য ধৈর্য! এমন কতকাল ধরিয়া প্ৰভাতের পরে প্রভাত আসিয়াছে, পাখির পরে পাখি গাহিয়াছে, ফুলের পরে ফুল ফুটিয়াছে, কেহ দেখে নাই, কেহ শোনে নাই। যাহাদের ইন্দ্ৰিয় ছিল কিন্তু অতীন্দ্ৰিয় ছিল না, তাহদের সম্মুখেও জগতের সৌন্দর্য উপেক্ষিত হইয়াও প্রতিদিন হাসিমুখে আবির্ভূত হইত। তাহারা গানের শব্দ শুনিত মাত্র, ফুলের ফোটা দেখিত মাত্র। সমস্তই তাঁহাদের নিকটে ঘটনা মাত্র ছিল। কিন্তু প্ৰতিদিন অবিশ্রাম দেখিতে দেখিতে, অবিশ্রাম শুনিতে শুনিতে ক্রমে তাহদের চক্ষুর পশ্চাতে আরেক চক্ষু বিকশিত হইল, তাহদের কর্ণের পশ্চাতে আরেক কৰ্ণ উদঘাটিত হইল। ক্রমে তাহারা ফুল দেখিতে পাইল, গান শুনিতে পাইলা। ধৈর্য্যই সৌন্দর্যের অস্ত্ৰ। পুরুষদের ক্ষমতা আছে, তাই এত কাল ধরিয়া রমণীদের উপরে অনিয়ন্ত্রিত কর্তৃত্ব করিয়া আসিতেছিল। রমণীরা আর কিছুই করে নাই, প্রতিদিন তাহাদের সৌন্দৰ্যখনি লইয়া ধৈর্যসহকারে সহিয়া আসিতেছিল। অতি ধীরে, ধীরে প্রতিদিন সেই সৌন্দর্য জয়ী হইতে লাগিল। এখন দানববল সৌন্দৰ্য-সীতার গায়ে হাত তুলিতে শিহরিয়া উঠে। সভ্যতা যখন বহুদূর অগ্রসর হইবে, তখন বর্বরেরা কেবলমাত্র শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতামাত্রের পূজা করিবে না। তখন এই স্নেহপূর্ণ ধৈৰ্য, এই আত্মবিসর্জন, এই মধুর সৌন্দর্য, বিনা উপদ্রবে। মনুষ্যহীদয়ে আপন সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করিয়া লইবে। তখন বিষ্ণুদেবের গদার কাজ ফুরাইবে, পদ্ম ফুটিয়া উঠিবে। পূর্বেই বলিয়াছি, সৌন্দর্য পৃথিবীতে স্বর্গের বার্তা আনিতেছে। যে বধির, ক্রমশ তাহার বধিরতা দূর হইতেছে। বৈষ্ণব জ্ঞানদাসের একটি গান পাইয়াছি, তাহাই ভালো করিয়া বুঝিতে গিয়া আমার এত কথা মনে পড়িল - মুরলী করাও উপদেশ। যে রান্ধে যে ধ্বনি উঠে জানহ। বিশেষ। কোন রন্ধে বাজে বাশি অতিঅনুপাম। কোন রন্ধে রাধা বলে ডাকে আমার নাম। কোন রন্ধে বাজে বাশি সুললিতধ্বনি। কোন রন্ধে কেকা শব্দে নাচে ময়ুরিণী। কোন রন্ধে রসালে ফুটিয়ে পারিজাত। কোন রন্ধে কদম্ব ফুটে হে প্ৰাণনাথ। কোন রন্ধে ষড় ঋতু হয় এককালে। কোন রন্ধে নিধুবন হয় ফুলে ফলে। কোন রন্ধে কোকিল পঞ্চম স্বরে গায়। একে একে শিখাইয়া দেহো শ্যামরায়। জ্ঞানদাস কহে হাসি। “রাধে মোর” বোল বাজিবেক বাশি।