পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা td হাস্যরসোদ্দীপক অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করিলে মাত্র, কিন্তু আসলে কী করিলে! সেই অর্থহীন প্রথার মন্দিরমধ্যে অধিষ্ঠিত সুমহৎ অতীতদেবকে ভাঙিয়া ফেলিলে, একটি জীবন্ত ইতিহাসকে বধ করিলে, তোমার পূর্বপুরুষদিগের একটি স্মরণচিহ্ন ধ্বংস করিয়া ফেলিলে। তোমার কাছে তোমার মায়ের যদি একটি স্মরণচিহ্ন থাকে, বাজারে তাহার দাম নাই বলিয়া তোমার কাছেও যদি তাহার দাম না থাকে। তবে তুমি মহাপাতকী। তেমনি অনেকগুলি অর্থহীন প্ৰথা পূর্বপুরুষদিগের ইতিহাস বলিয়াই মূল্যবান। তুমি যদি তাহার মূল না দেখিতে পাও, তাহা অকাতরে ফেলিয়া দাও, তবে তোমার শরীরে দয়াধৰ্ম কোনখানে থাকে তাহাই আমি ভাবি । যাহাদের বুট-তরী আশ্রয় করিয়া তোমরা ভবসমুদ্র পার হইতে চাও, সেই ইংরাজ মহাপুরুষেরা কী করেন একবার দেখো-না। তাহদের রাজসভায়, তাহদের পার্ল্যামেন্ট সমিতিতে, এবং অন্যান্য নানা স্থলে কতশত প্রকার অর্থহীন অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে, তাহা কে না জানে! অতীত কাল ধরণীর মতো আমাদের অচলপ্রতিষ্ঠা করিয়া রাখে। যখন বাহিরে রৌদ্রের খরতর তাপ, আকাশ হইতে বৃষ্টি পড়ে না, তখন শিকড়ের প্রভাবে আমরা অতীতের অন্ধকার নিম্নাতন দেশ হইতে রস আকর্ষণ করিতে পারি। যখন সকল সুখ ফুরাইয়া গেছে তখন আমরা পিছন ফিরিয়া অতীতের ভগ্নাবশিষ্ট চিহ্নসকল অনুসরণ করিয়া অতীতে যাইবার পথ অনুসন্ধান করিয়া লই। বর্তমানে যখন নিতান্ত দুৰ্ভিক্ষ নিতান্ত উৎপীড়ন দেখি তখন অতীতের মাতৃক্ৰোড়ে বিশ্রাম করিতে যাই। বাংলা সাহিত্যে যে এত পুরাতত্ত্বের আলোচনা দেখা যাইতেছে তাহার প্রধান কারণ, আমাদের একমাত্র সাস্তুনার স্থল অতীত কালকে জীবন্ত করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইতেছে। সে পথও যদি কেহ বন্ধ করিতে চায়, অতীতেব যাহা-কিছু অবশেষ আমাদের ঘরে ঘরে পডিয়া রহিয়াছে তাহাকে দূর করিয়া যদি কেহ অতীতকে আরো অতীতে ফেলিতে চায়, তবে সে সমস্ত জাতির অভিশাপের পাত্ৰ হইবে। যদি আমরা অতীতকে হারাই তবে আমরা কতখানি হারাই! আমাদের কতটুকু প্ৰাণ থাকে! একটি নিমেষ মাত্ৰ লইয়া কিসের সুখ! আমাদের জীবন যদি কতকগুলি বিচ্ছিন্ন জলবিম্ব মাত্র হয়, তবে তাহা অত্যন্ত দুর্বল জীবন। কিন্তু আমাদের জীবনের জন্মশিখর হইতে আরম্ভ করিয়া সাগরসঙ্গম পর্যন্ত যদি যোগ থাকে। তবে তাহার কত বল। তবে তাহা পাষাণের বাধা মানিবে না, কথায় কথায় রৌদ্রতাপে শুকাইয়া বাষ্প হইয়া যাইবে না। আমি কিছু পরগাছা নহি, গাছ হইতে গাছে বুলিয়া বেড়াই না। বাহিরের রৌদ্র, বাহিরের বাতাস, বাহিরের বৃষ্টি আমি ভোগ করিতেছি, কিন্তু মাটির ভিতরে ভিতরে প্রসাবিত আমার অতীতের উপর আমি দাড়াইয়া আছি। আমার অতীতের মধ্যে আমার কতকগুলি তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন বর্তমানে পাপে তাপে শোকে কাতর হইয়া পড়ি তখন সেই তীৰ্থস্থানে গমন করি, সরল বাল্যাকালের সমীরণ ভোগ করি।- নবজীবনের প্রথম সংকল্প, মহৎ উদ্দেশ্য, তরুণ আশাসকল পুনরায় দেখিতে পাই। আমার এ অতীতের পথ যদি মুছিয়া যাইত তাহা হইলে আজ। আমি কী হাইতাম! একটি জরাজীর্ণ কঠোরহৃদয় অবিশ্বাসী বিদ্রুপ-পরায়ণ বৃদ্ধ হইয়া উদাসনেত্ৰে সংসারের দিকে চাহিয়া থাকিতাম । এইজনাই আমি এই:-সকল অতিশয় তুচ্ছদ্রব্যগুলিকে, অতীত কালের অতি সামান্য চিহ্নটুকুকেও যত্ন করিয়া রাখিয়াছি; অত্যধিক জ্ঞানলাভ করিয়া কুসংস্কারের অত্যন্ত অভাবে সেগুলিকে অনাবশ্যক-বোধে ফেলিয়া দিই নাই। তার্কিক কেহ কেহ বলেন, র্যাহাদের সঙ্গে মতের মিল নাই, প্রতি কথায় যুক্তির লাঠালাঠি চলে, তর্কবিতর্ক না করিয়া র্যাহারা এক পা অগ্রসর হইতে দেন না, তাহদের সহবাসে উপকার আছে। তাহদের উৎপাতে কাচা কথা বলিবার জো থাকে না, দুর্বল মত ত্ৰাহি ত্ৰাহি করিতে থাকে, খুব খাটি মত না