পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ62 রবীন্দ্র-রচনাবলী হইলে টিকিতে পারে না। বুদ্ধিরাজ্যে Survival of the Fittest নিয়ম খুব ভালোরূপে বজায় থাকে। এ কথাটা আমার তো ঠিক মনে হয় না। আমাদের কোনো ভাব আহিরাবণের মতো একেবারে জন্মিয়াই কিছু যুদ্ধ আরম্ভ করিতে পারে না। কিছু দিন ধরিয়া প্ৰশংসা, বন্ধুদিগের মমতা ও অনুকুল যুক্তির লঘুপাক ও পুষ্টিকর খাদ্য তাহাকে রীতিমত সেবন করানো আবশ্যক। যখন সে পায়ের উপর দাড়াইতে পরিবে, তখন বরঞ্চ, মাঝে মাঝে হঁচট খাওয়া, মাথা ঠোকা, পডিয়া যাওয়া মন্দ নহে। কিন্তু যেমনি আমার ভাবটি জন্মগ্রহণ করিল, অমনি যদি আমার নৈয়ামিক কুস্তিওয়ালা খাঁক করিয়া তাহার গলা চাপিয়া ধরেন তবে তো তাহাব আর বাচিবাব সম্ভাবনা থাকে না। বন্ধুবান্ধবের সহিত কথাবার্তা কহিতে কহিতে প্রতি মুহুর্তে আমাদের নূতন নূতন মত জন্মগ্রহণ করিতে থাকে। কোনো বিষয়ে আমাদের যথার্থ মত কী, আমাদের যথার্থ বিশ্বাস কী, তাহা সহসা জিজ্ঞাসা করিলে আমরা বলিতে পারি না, আমরা নিজেই হয়তো জানি না; বন্ধুদিগের সহিত কথোপকথনের আন্দোলনে তাহারা ভাসিয়া উঠে। তখন আমরা তাহাদিগকে প্রথম দেখিতে পাই । সুতরাং তখনো আমরা আমাদের সেই কচি ভাবগুলিকে যুক্তির বর্ম দিয়া আচ্ছাদন কবিবার অবসর পাই নাই, তখনো তাহাদিগকে সংসারের কঠোর মাটির উপরে হাঁটাইতে শিখাই নাই, নানা শাস্ত্ৰ হইতে আহরণ করিয়া তাহাদের অনুকুল মতগুলিকে বডিগার্ডের মতো তাহদের চারি দিকে খাড়া করিয়া দিই নাই। এমন সময়ে যদি নৈয়ায়িক শিকারীর ইঙ্গিতে দেশী বিলাতী, আধুনিক প্রাচীন, যত দেশের যত ন্যায়শাস্ত্রের যতগুলা যুক্তির ক্ষুধিত খেকি কুকুর আছে, সকলগুলা একবারে দাত খিচাইয়া সেই অসহায়দের উপর আসিয়া পডে, facts-নামক ছোটো ছোটাে ইট পাটকেল চার দিক হইতে তাহদের উপর বর্ষিত হইতে থাকে, তবে সে বেচারীরা দাড়ায় কোথায় ? তুমি নৈয়ায়িক, Facts নামক গোটাকতক সরকারি লাঠিয়াল তোমার হাত-ধরা আছে, তোমার যাহা-কিছু আছে মান্ধাতার আমল হইতে তাহার জোগাড় হইয়া আসিতেছে, আর আমার এই ভাবশিশু এই মুহুর্তে সবে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, ইহার প্রতি আক্রমণ করিয়া তোমার পৌরুষ কী % আর একটু রোস'। এখনো ইহা কথোপকথনের কোলে কোলে ফিরিতেছে। যখন এ সাহিত্যক্ষেত্রে রণভূমিতে দাড়াইবে, তখন ইহাতে তোমাতে বোঝাপড়া চলিতে পরিবে। এই-সকল ন্যায়শাস্ত্ৰবিদেরা রসিকতার কৈফিয়ত চাহেন; বিদ্রুপ করিয়া একটা অসংগত কথা কহিলে তর্কের দ্বারায় তাহার অযৌক্তিকতা প্ৰতিপন্ন করাইয়া দেন। কথায় কথায় যদি একটা ঐতিহাসিক fact-এর উল্লেখ করি, সেটা আব-সকল বিষয়ে যেমনই সংগত হউক-না কেন, তাহার তারিখের একটু ইতস্তত হইলে তৎক্ষণাৎ তাহার। পাচ volume ইতিহাসের চাপে সেটাকে ছারপোকার মতো মারিয়া ফেলেন; মুখে মুখে যদি একটা কিছুর সহিত কিছুর তুলনা করি, অমনি তিনি ফিতা হাতে কবিয়া অত্যন্ত পরিশ্রমে তাহার মাপজোক করিতে আরম্ভ করেন; আমি বলিলাম, অমুক লোকটা নিতান্ত গাধার মতো, তিনি আমনি বলিলেন- সে কেমন কথা, তাহার তো চারটে পা নাই, আর তাহার কান দুটা কিছু নিতান্তই বড়ো নয়, তাহার গলার আওয়াজ ভালো নহে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া কি গাধার সঙ্গে তাহার তুলনা হয়? আমি বলিলাম, হে বুদ্ধিমান, গাধার বুদ্ধির সহিত আমি তাহার বুদ্ধির তুলনা করিতেছিলাম, আর কোনো বিষয়ে সাদৃশ্য আছে বলিয়া মনে হয় নাই। তিনি অমনি বলিলেন, তাহাও কি ঠিক মেলে? পশু বস্তুই দেখিতে পায়, কিন্তু বস্তুর বস্তুত্ব কি সে মনে করিতে পারে! সে শ্বেতবর্ণ পদার্থ মনে আনিতেও পারে, কিন্তু শ্বেতবর্ণ-নামক পদার্থী-অতিরিক্ত একটা ভাবমাত্র সে কি মনে ধারণা করিতে পারে? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কাতর হইয়া বলিলাম, দোহাই, মাপ করো, আমার অপরাধ হইয়াছে, এবার হইতে গাধার সহিত তাহার বুদ্ধির তুলনা না দিয়া তোমার সহিত দিব! শুনিয়া তিনি সন্তুষ্ট হইলেন। এইরূপ র্যাহারান্তর্কিক বন্ধুদিগের সহবাসে থাকেন, তাহদের ভাবের উৎসমুখে পাথর চাপানো থাকে। বন্ধুত্বের দক্ষিণা বাতাস বন্ধুদিগের অনুকুল হাস্যের সূর্যকিরণের অভাবে তাহদের হৃদয়কাননের