পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উঠে এমন আর কোথাও নয়। একটা গাছে কতশত বীজ জন্মে। তাহার মধ্যে সবগুলা কিছু গাছ হয় না। কিন্তু গুটিকত গাছ জন্মাইবার উদ্দেশে বিস্তর নিস্ফল বীজ জন্মানো আবশ্যক। আমাদেরও সকল ভােব কিছু সফল হইবে না। কিন্তু ভাবের প্রচুরতা আবশ্যক। গোটাকতক থাকিবে, অনেকগুলি মরিবে। কিন্তু প্ৰতিকূলতার প্রখর প্রভাবে যদি ভাবের বিকাশ একেবারেই বন্ধ হয় তবে আর কী হইল ? তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি সাহিত্যে প্রতিকৃলি সমালোচনা কি ভালো ? ভালো বইয়ের ভালো সমালোচনা ভালো, কুরুচিবিকাশক হানিজনক বইয়ের নিন্দা করাও দোষের নহে, কিন্তু লেখকের, ক্ষমতাব অভাবে বা বুদ্ধির দোষে অসম্পূৰ্ণ গ্রন্থগুলিকে কঠোর ভাবে সমালোচনা করিলে তাহাতে কী ভালো হয় বুঝিতে পারি না। नऊद्ध ऊ९* সীতাকে আংশিক ভাবে দেখিলে অনেক সময়ে তাহা মিথ্যার রূপান্তর ধারণ করে। এক পাশ হইতে একটা জিনিসকে দেখিয়া যাহা সহসা মনে হয় তাহা একপেশে সত্য, তাহা বাস্তবিক সত্য না হইতেও পারে। আবার অপর পক্ষেও একটা বলিবার কথা আছে। কেহ সত্যকে সর্বতোভাবে দেখিতে পায় না। সত্যকে যথাসম্ভব সর্বতোভাবে দেখিতে গেলে প্ৰথমে তাহাকে আংশিক ভাবে দেখিতে হইবে, তাহা ব্যতীত আমাদের আর গতি নাই। ইহা আমাদের অসম্পূর্ণতার ফল। আমরা কিছু একেবারেই একটা চাবি- কোণা দ্রব্যের সবটা দেখিতে পাই না— ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখিতে হয়। এই নিমিত্ত উচিত এই যে, যে যে-দিকটা দেখিয়াছে সে সেই দিকটাই সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করুক, অবশেষে সকলের কথা গাথিয়া একটা সম্পূৰ্ণ সত্য পাওয়া যাইবে। আমাদের এক-চোখো মন লইয়া সম্পূর্ণ সত্য জানিবার আর কোনো উপায় নাই। আমরা একদল অন্ধ, আর সত্য একটি হস্তী। স্পর্শ করিয়া করিয়া সকলেই হস্তীর এক-একটি অংশের অধিক জানিতে পারি না। এইজনাই কিছু দিন ধরিয়া হস্তীকে কেহ-বা স্তম্ভ, কেহ-বা সাপ, কেহ-বা কুলা বলিয়া ঘোরতর বিবাদ করিয়া থাকি; অবশেষে সকলের কথা মিলাইয়া বিবাদ মিটাইয়া লই। আমি যে ভূমিকাচ্ছলে এতটা পুরাতন কথা বলিলাম, তাহার কারণ এই— আমি জানাইতে চাই, একপেশে লেখার উপর আমার কিছু মাত্র বিরাগ নাই। এবং আমার মতে, যাহারা একেবারে সত্যের চারি দিক দেখাইতে চায়, তাহারা কোনো দিকই ভালো করিয়া দেখাইতে পারে না- তাহারা কতকগুলি কথা বলিয়া যায়, কিন্তু একটা ছবি দেখাইতে পারেনা। একটা উদাহরণ দিলেই আমার কথা বেশ স্পষ্ট হইবে। একটা ছবি আঁকিতে হইলে, যথার্থত যে দ্রবা যেরূপ ঠিক সেরূপ আকা উচিত নহে। যখন চিত্রকর নিকটের গাছ বড়ো করিয়া আঁকে ও দূরের গাছ ছোটাে করিয়া আঁকে, তখন তাহাতে এমন বুঝায় না যে বাস্তবিকই দূরের গাছগুলি আয়তনে ছোটাে। একজন যদি কোনো ছবিতে সব গাছগুলি প্ৰায় সম-আয়তনে উমাকে, তবে তাহাতে সত্য বজায় থাকে বটে, কিন্তু সে ছবি আমাদের সত্য বলিয়া মনে হয় না- অর্থাৎ তাহাতে সত্য আমাদের মনে অঙ্কিত হয় না। লেখার বিষয়েও তাঁহাই বলা যায়। আমি যে ভাবটা নিকটে দেখিতে পাই, সেই ভাবটা যদি বড়ো করিয়া না আঁকি ও তাহার বিপরীত দিকের সীমান্ত যদি অনেকটা ক্ষুদ্র, অনেকটা ছায়াময়, অনেকটা অদৃশ্য করিয়া না দিই- তবে তাহাতে কোনো উদ্দেশ্যই ভালো করিয়া সাধিত হয় না; না। সমস্তটার ভালো ছবি পাওয়া যায়, না একাংশের ভালো ছবি পাওয়া যায়। এইজনাই লেখক-চিত্রকরদিগকে পরামর্শ দেওয়া যায়, যে যে-ভাবটাকে কাছে দেখিতেছি, তাহাই বড়ো করিয়া আঁকো; ভাবিয়া চিন্তিয়া, বিচার করিয়া, সত্যের সহিত পরামর্শ করিয়া, ন্যায়কে বজায় রাখিবার জন্য তাহাকে খাটাে করিবার কোনো আবশ্যক নাই ।