পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ\ტ রবীন্দ্র-রচনাবলী তোমাদের আত্মম্ভরিতা-নামক লাঙ্গুলোর প্রসরটা অত্যন্ত অধিক- নিজ-রচিত কুণ্ডলিত লাঙ্গুল-সিংহাসনের উপর বসিয়া দূরবীক্ষণের উলটা দিক দিয়া জগৎসংসারকে দেখিতেছি। তোমাদের শরীরের আয়তন অধিক নহে, কিন্তু লেজ হইতে মাপিলে অনেকটা হয়। বিজ্ঞতার হৃদয় যদি এতটা প্রশস্ত হয় যে পরকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলে তাহার বক্ষে স্থান কুলায়, কুঞ্চিতচর্ম সংশয়ের নাম যদি বিজ্ঞতা না হয়, তবে সেই বিজ্ঞতা উপার্জনের জন্য চেষ্টা করিব। তোমাদের বিজ্ঞাতায় যে সূর্যের আলো নাই, বসন্তকাননের শ্যামল বর্ণ নাই। তোমাদের বিজ্ঞতা সমুদয় জগৎকে অবিশ্বাস করিয়া অবশেষে একটি দুই-হাত-পরিমাণ ডোবার মধ্যে নিজেকে বদ্ধ করিয়াছে ও আপনাকে সমুদ্রের চেয়ে গভীর মনে করিতেছে, চন্দ্র সূর্যের হাসিকে চপলতা জ্ঞান করিতেছে। অনবরত পচিয়া উঠিতেছে ও মুখটা আধার করিয়া সুগভীর চেহারা বাহির করিতেছে। তোমাদের বিজ্ঞতার প্রাণটা একরাত্তি, তাহাকে ছুইলেই কচ্ছপের মতো সে নিজের পেটের মধ্যে প্ৰবেশ করে; তোমাদের বিজ্ঞতার হাসিতে কৃপণতা, তাহার ভাষায় দুৰ্ভিক্ষ, তাহার আলিঙ্গন কঁকড়ার আলিঙ্গনের মতো, জিনিস কিনিয়া সে কানাকড়ি দিয়া তাহার দাম শোধ করে! এ বিজ্ঞতা লইয়া তোমরাই গৰ্ব্ব কর । যে বিজ্ঞ সদনুষ্ঠানকে উপহাস করে, তাহা অপেক্ষা যে সরল ব্যক্তি সদনুষ্ঠানে চেষ্টা করিয়া অকতকার্য হইয়াছে সে মহৎ; যে মশক হস্তীকে বিব্রত করিয়া তোলে সে মশক হস্তীর চেয়ে বড়ো নহে; যে পাকে সৎপথগামী সাধুর পা বসিয়া গেছে, সে পাকের জ্ঞাক করিবার বিষয় কিছুই নাই। সংশয় করিয়া, বিদ্রুপ করিয়া, অসৎ অভিসন্ধি আবিষ্কার করিয়া অনেক বিজ্ঞ অনেক সৎকার্যকে অন্ধুরে দলিত দগ্ধ করিয়াছেন, অনেক উন্মুখ প্ৰতিভাকে নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করিয়া হয়তো পৃথিবীর এক-একটা শতাব্দীকে অনুর্বর মরুময় করিয়া দিয়াছেন— ইহাৱা যদি এই-সকল দলিত অঙ্কুর, দগ্ধ আশা, ভগ্ন সমকক্ষ হইতে পারে? রোগ দুর্ভিক্ষের সহােদর বিজ্ঞতা শ্মশানের ভস্ম দিয়া একটা উৎসব।াগার নির্মাণ করিয়াছে, সেখানে অস্থিকঙ্কালের নৃত্য হইতেছে, হৃদয়শোণিতের মদ্যপান চলিতেছে, খরধার রসনাখড়ের্গ আশা-উদ্যমের বলি হইতেছে। আইস, যাহাদের হৃদয় আছে, আমরা প্রকৃতিমাতার উৎসবালয়ে যাই। সেখানে জীবনের অভিনয় হইতেছে, সেখানে সৌন্দর্যের উৎস উৎসারিত হইতেছে, সেখানে মাপজোকা কার্পণ্য নাই, সেখানে বাকাচোরা অনুদারতা নাই- সেখানে দুইমুখা প্ৰাণ নাই। এ-সকল বিজ্ঞলোকদের সহিত আমাদের পোষাইবে না- আমরা ইহাদের চিনিতে পারিব না, ইহাদের কথা ভালো বুঝিতে পারিব না- ইহারা উপদেশ দিবার সময় বড়ো বড়ো নীতিকথা বলে, কিন্তু ইহাদের মনে পাপ আছে, ইহাদের সর্বাঙ্গে সংক্ৰামক রোগ। মেঘনাদবধ কাব্য সকলেই কিছু নিজের মাথা হইতে গড়িতে পারে না, এইজন্যই ছাচের আবশ্যক হয়। সকলেই কিছু কবি নহে, এইজন্য অলংকার শাস্ত্রের প্রয়োজন। গানের গলা অনেকেরই আছে, কিন্তু গানের প্রতিভা অল্প লোকেরই আছে, এইজন্যই অনেকেই গান গাহিতে পারেন না, রাগ-রাগিণী গাহিতে পারেন। হৃদয়ের এমন একটা স্বভাব আছে, যে, যখনি তাহার ফুলবাগানে বসন্তের বাতাস বয় তখনি তার গাছে গাছে ডালে ডালে আপনি কুঁড়ি ধরে, আপনি ফুল ফুটিয়া উঠে। কিন্তু যার প্রাণে ফুলবাগান নাই, সুসঙ্কের বাতাস বয়ন, সে কী করে? সে পার্টার্ন কিনিয়া চোখে চশমা দিয়া পশমের ফুল তার করে। আসল কথা এই, যে সৃজন করে তাহার ছাচ থাকে না, যে গড়ে তাহার ছাঁচ চাই। অতএব উভয়কে এক নামে ডাকা উচিত হয় না।