পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Jaba ዓዒ পাশাপাশি ধরা যাইতে পারে। সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্মাণ করে। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দিই ও সংগীতে সুরের ভাষাকে প্রাধান্য দিই। যেমন, কথোপকথনে আমরা যে-সকল কথা যেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি, কবিতায় আমরা সে-সকল কথা সেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি না- কবিতায় আমরা বাছিয়া বাছিয়া কথা লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি।- তেমনি কথোপকথনে আমরা যে-সকল সুর যেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি সংগীতে সে-সকল সুর সেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি না, সুর বাছিয়া বাছিয়া লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি। কবিতায় যেমন বাছা বাছা সুন্দর কথায় ভােব প্রকাশ করে, সংগীতেও তেমনি বাছা বাছা সুন্দর সুরে ভাব প্রকাশ করে। যুক্তির ভাষায় প্রচলিত কথোপকথনের সুর ব্যতীত আর কিছু আবশ্যক করে না। কিন্তু যুক্তির অতীত আবেগের ভাষায় সংগীতের সুর আবশ্যক করে। এ বিষয়েও সংগীত অবিকল কবিতার ন্যায়। সংগীতেও ছন্দ আছে। তালে তালে তাহার সুরের লীলা নিয়মিত হইতেছে। কথোপকথনের ভাষায় সুশৃঙ্খল ছন্দ নাই, কবিতার ছন্দ আছে, তেমনি কথোপকথনের সুরে সুশৃঙ্খল তাল নাই, সংগীতে তাল আছে। সংগীত ও কবিতা উভয়ে ভাবপ্রকাশের দুইটি অঙ্গ ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছে। তবে, কবিতা ভাবপ্রকাশ সম্বন্ধে যতখানি উন্নতি লাভ করিয়াছে, সংগীত ততখানি করে নাই। তাহার একটি প্রধান কারণ আছে। শূন্যগর্ভ কথার কোনো আকর্ষণ নাই- না তাহার অর্থ আছে, না। তাহা কানে তেমন মিঠা লাগে। কিন্তু ভাবশূন্য সুরের একটা আকর্ষণ আছে, তাহা কানে মিষ্ট শুনায়। এইজনা ভাবের অভাব হইলেও একটা ইন্দ্ৰিয়সুখ তাহা হইতে পাওয়া যায়। এই নিমিত্ত সংগীতে ভাবের প্রতি তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় নাই। উত্তরোত্তর আস্কারা পাইয়া সুর বিদ্রোহী হইয়া ভাবের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে। এক কালে যে দাস ছিল আর-এক কালে সেই প্ৰভু হইয়াছে। চক্ৰবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানিচ সুখানিচ- কিন্তু এ চক্র কি আর ফিরিবে না? যেমন ভারতবর্ষের ভূমি উর্বর হওয়াতেই ভারতবর্ষের অনেক দুৰ্দশা, তেমনি সংগীতের ভূমি উর্বরা হওয়াতেই সংগীতের এমন দুৰ্দশা। মিষ্ট সূরা শুনিবা মাত্ৰই ভালো লাগে, সেই নিমিত্ত সংগীতকে আর পরিশ্রম করিয়া ভাব কর্ষণ করিতে হয় নাই- কিন্তু শুদ্ধ মাত্র কথার যথেষ্ট মিষ্টতা নাই বলিয়া কবিতাকে প্ৰাণের দায়ে ভাবের চর্চা করিতে হইয়াছে, সেই নিমিত্তই কবিতার এমন উন্নতি ও সংগীতের এমন অবনতি । অতএব দেখা যাইতেছে, যে, কবিতা ও সংগীতে আর কোনো তফাৎ নাই, কেবল ইহা ভাবপ্রকাশের একটা উপায়, উহা ভাবপ্রকাশের আর-একটা উপায় মাত্র। কেবল অবস্থার তারতম্যে কবিতা উচ্চশ্রেণীতে উঠিয়াছে ও সংগীত নিম্নশ্রেণীতে পড়িয়া রহিয়াছে; কবিতায় বায়ুর ন্যায় সূক্ষ্ম ও প্রস্তরের ন্যায় স্কুল সমুদয় ভােবই প্রকাশ করা যায়, কিন্তু সংগীতে এখনও তাহা করা যায় না। কবি Mathew Arnold GISIN "Epilogue to Lessing's Laocoon" =Skaos of Olssos FS ও কবিতার যে প্ৰভেদ স্থির করিয়াছেন, সংক্ষেপে তাহার মর্ম নিজ ভাষায় নিম্নে প্ৰকাশ করিলাম। তিনি বলেন- চিত্রে প্রকৃতির এক মুহুর্তের বাহ্য অবস্থা প্ৰকাশ করা যায় মাত্র। যে মুহুর্তে একটি সুন্দর মুখে হাসি দেখা দিয়াছে সেই মুহুর্তটি মাত্র চিত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার পরমুহুর্তটি আর তাহাতে নাই। যে মুহূর্তটি তাহার শিল্পের পক্ষে সর্বাপেক্ষা শুভ মুহুর্ত সেই মুহুর্তটি অবিলম্বে বাছিয়া লওয়া প্রকৃত চিত্রকারের কাজ। তেমনি মনের একটি মাত্র স্থায়ী ভাব বাছিয়া লওয়া, ভাবশৃঙ্খলের একটি মাত্র অংশের উপর অবস্থান করিয়া থাকা সংগীতের কাজ। মনে করো, আমি বলিলাম, “হায়।” কথাটা ঐখানেই ফুরাইল, কথায় উহার অপেক্ষা আর অধিক প্রকাশ করিতে পারে না। আমার হৃদয়ের একটি অবস্থাবিশেষ ঐ একটি মাত্র ক্ষুদ্র কথায় প্রকাশ হইয়া অবসান হইল। সংগীত সেই “হায়" শব্দটি লইয়া তাহাকে বিস্তার করিতে থাকে, “হায়" শব্দের হৃদয় উদঘাটন করিতে থাকে, “হায়” শব্দের হৃদয়ের মধ্যে যে গভীর দুঃখ, যে অতৃপ্ত বাসনা, যে আশার জলাঞ্জলি প্রচ্ছন্ন আছে, সংগীত তাঁহাই টানিয়া টানিয়া বাহির করিতে থাকে, “হায়” শব্দের প্রাণের মধ্যে যতটা কথা ছিল সবটা তাহাকে দিয়া বলাইয়া লয়। কিন্তু কবিতার কাজ আরো বিস্তৃত। চিত্রকরের ন্যায় মুহুর্তের বাহা শ্ৰীও তাহার বর্ণনীয়, গায়কের