পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

rO 飘 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী এই সমুদ্রের বক্ষে ভাসমান করা ভাবগত কবিতার কাজ। ভাবগত কবিতায় হৃদয়ের স্বাস্থ্য সম্পাদন করে। ইন্দ্ৰিয়জগৎ হইতে মনকে আর-এক জগতে লইয়া যায়। দৃশ্যমান জগতের সহিত সে জগতের সাদৃশ্য থাকুক বা না থাকুক সে জগৎ সত্য জগৎ, অলীক জগৎ নহে। ভাবুক লোক মাত্রেই অনুভব করিয়াছেন যে, আমরা মাঝে মাঝে এক প্রকার বিষন্ন সুখের ভাব উপভোগ করি, তাহা কোমল বিষাদ, অপ্রখর সুখ। তাহা আর কিছু নয়, সীমা হইতে অসীমের প্রতি নেত্রপাত মাত্র। কোন কোন সময়ে আমাদের হৃদয়ে ঐ প্রকার ভাবের আবির্ভাব হয় তাহা আলোচনা করিয়া দেখিলেই উক্ত বাক্যের সত্যতা প্রমাণ হইবে। জোৎস্নারাত্ৰে, দূর হইতে সংগীতের সুর শুনিলে, সুখস্পর্শ বসম্ভের বাতাস বহিলে, পুষ্পের ঘাণে, আমাদের হৃদয় কেমন আকুল হইয়া উঠে— উদাস হইয়া যায়। কিন্তু জ্যোৎস্না সঙ্গীত বসন্তবায়ু সুগন্ধের ন্যায় সুখসেব্য পদার্থের উপভোগে আমাদের হৃদয় আমন আকুল হয় কী কারণে? কেন, সুমিষ্ট দ্রব্য আহার করিলে বা সুস্নিগ্ধ জলে স্নান করিলে তো আমাদের মন ঐরাপ উদাস ও আকুল হইয়া উঠে না। যখন আহার করি তখন সুস্বাদ ও উদরপূর্তির সুখমাত্র অনুভব করি, আর কিছু নয়। কিন্তু জোৎস্নারাত্রে কেবলমাত্র যে নয়নের পরিতৃপ্তি হয় তাহা নহে, জোৎস্নায় একটা কী অপরিস্ফুট ভাব মনে আনয়ন করে। যতটুকু সম্মুখে আছে কেবল ততটুকু মাত্ৰই যে উপভোগ করি তাহা নহে, একটা অবর্তমান রাজ্যে গিয়া পৌছাই । তাহার কারণ এই যে, জ্যোৎস্না উপভোগ করিয়া আমাদের তৃপ্তি হয় না। চারি দিকে জ্যোৎস্না দেখিতেছি, অথচ জ্যোৎস্না আমরা পাইতেছি না। ইচ্ছা করে জ্যোৎস্নাকে আমরা সৰ্ব্বতোভাবে উপভোগ করি, জ্যোৎস্নাকে আমরা আলিঙ্গন করি, কিন্তু জ্যোৎস্নাকে ধরিবার উপায় নাই। বসন্তবায়ু হু হু করিয়া বহিয়া যায়। কে জানে কোথা হইতে বহিল! কোন অদৃশ্য দেশ হইতে আসিল, কোন অদৃশ্য দেশে চলিয়া গেল!! আসিল চলিয়া গেল, বড়োই ভালো লাগিল; কিন্তু তাহাকে দেখিলাম না, শুনিলাম না, সর্বতোভাবে আয়ত্ত করিতেই পারিলাম না। শরীরে যে স্পর্শ হইল তাহা অতি মৃদু স্পর্শ, কোমল স্পর্শ, কঠিন ঘন স্পর্শ নহে, কাজেই উপভোগে নানা প্রকার অভাব রহিয়া গেল। মধুর সংগীতে মন কাদিয়া ওঠে সেইজনোই । আবার জ্যোৎস্নারাত্রে সে সংগীত পুষ্পের গন্ধের সঙ্গে, বসন্তের বাতাসের সঙ্গে, দূর হইতে আসিলে মন উন্মত্ত করিয়া তুলে। অন্যান্য অনেক ঋতু অপেক্ষা বসন্ত ঋতুতে সকলই অপরিস্ফুট, মৃদু, কিছুই অধিক IAT SICo– দক্ষিণের দ্বার খুলি মৃদুমন্দগতি লতিকার গাটে গাটে ফুটাইছে ফুল, অঙ্গে ঘোরি পরাইছে পল্লবন্দুকল। কি জানি কিসের লাগি হইয়া উদাস ঘরের বাহির হ’ল মলয় বাতাসভয়ে ভয়ে পদাপয়ে তবু পথ ভুলে, গন্ধমদে ঢলি পড়ে এ ফুলে ও ফুলে। মনের আনন্দ আর না পারি। রাখিতে, কোথা হতে ডাকে পিক রসালিশাখীতে, কুহু কুহু কুহু কুহু কুঞ্জে কুঞ্জে ফিরে, ক্রমে মিলাইয়া যায় কাননগভীরে! কোথা হইতে বাতাস উদাসী হইয়া বাহির হইল, কোথায় সে যাইবে তাহার ঠিক নাই, অতি ভয়ে ভয়ে অতি ধীরে ধীরে তাহার পদক্ষেপ। কোকিল কোথা হইতে সহসা ডাকিয়া উঠিল এবং তাহার স্বর কোথায় যে মিলাইয়া গেল তাহার ঠিকানা পাওয়া গেল না। এক দিকে উপভোগ করিতেছি আর-এক দিকে তৃপ্তি হইতেছে না, কেননা উপভোগ্য সামগ্ৰীসকল আমাদের আয়ত্তের মধ্যে নহে। এক দিকে মাত্র সীমা, অন্য দিকে অসীম সমুদ্র। মনে হয়, যদি ঐ সমুদ্র পার হইতে পারি, তবে আমাদের