পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ե Հ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অঙ্গহীন করিয়া, রঙ চং মাখাইয়া ভাড় সাজাইয়া, রাস্তায় দাড় করাইয়া, দশ জন অলস লঘুহৃদয় পথিকের দুই পাটি দাত বাহির করাইলে সে কবির পক্ষে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়- ইহাতে ইংরাজ-হৃদয়ের এক অংশের শোচনীয় অঙ্গহীনতা প্ৰকাশ পায়। আমাদের জাতীয় ভােব এরূপ নহে। যদি একজন বৃদ্ধ পূজনীয় ব্যক্তিকে অপদস্থ করিবার জন্য সভামধ্যে কেহ তাহার হৃদয়নিঃসৃত কথাগুলি বিকৃত স্বরে উচ্চারণ করিয়া মুখভঙ্গি করিতে থাকে, তবে তাহাকে দেখিয়া রসিক পুরুষ মনে করিয়া যাহার হাসে তাহদের ধোবা নাপিত বন্ধ করিয়া, দেওয়া উচিত। টেনিসনের De Profundiৎ কবিতাটি যে সমাদৃত হয় নাই তাহার একটা কারণ, বিষয়টি অতান্ত গভীর, গুরুতর। আর একটা কারণ, ইহাতে এমন কতকগুলি ভাব আছে যাহা সাধারণত ইংরাজেরা বুঝিতে পারেন না, আমরাই সে-সকল ভােব যথার্থ বুঝিবার উপযুক্ত। ইংরাজিবাগীশ শিক্ষিত বাঙালিদের অনেকে ইংরাজি কাব্য দিশী ভাবে সমালোচনা করিতে ভয় পান। তাহারা বলেন, যদি ইংরাজ সমালোচকদের উক্তির সহিত দৈবাৎ অমিল হইয়া যায়! নাহয় তাহা হইল ! ইংরাজ সমালোচকের কথা ইংরাজি হিসাবে যেরূপ সত্য, আমাদের দেশীয় সমালোচকের কথা আমাদের দেশী হিসাবে তেমনি সত্য। উভয়ই বিভিন্ন অথচ উভয়ই সত্য হইতে পারে! গোলাপ ফুল যদি তাহার প্রতিবেশী পাতাকে সূর্যকিরণে সবুজ হইতে দেখিয়া মনে করে, সূর্যকিরণে আমারও সবুজ হওয়া উচিত ও সবুজ হইয়া উঠাই যদি তাহার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ফুলমণ্ডলী তাহাকে পাগল বলিয়া আশঙ্কা করে। De Profundis) কবিতাটি কবির সন্তানের জন্মোপলক্ষে লিখিত । সম্ভানের জন্মোপলক্ষে লিখিত কবিতা সাধারণত লোকে যে ভাবে পড়িতে যায়; এই কবিতায় সহসা তাহাতে বাধা পায়। কচি মুখ, মিষ্ট হাসি, আধ-আধ কথা ইহার বিষয় নহে! একটি ক্ষুদ্রকায়া সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে মিষ্টভাব কচিভাব ব্যতীত আরেকটি ভােব প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা সকলের চোখে পড়ে না। কিন্তু তাহা ভাবুক কবির চক্ষে পড়ে। সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে একটি অপরিসীম মহান ভাব, অপরিমেয় রহসা আবদ্ধ আছে, টেনিসন তাঁহাই প্ৰকাশ করিয়াছেন- সাধারণ পাঠকেরা তাহা বুঝিতে পারিতেছে না। অথবা এই অচেনা ভাব হৃদয়ের মধ্যে আয়ত্ত করিতে পারিতেছে না। Tennyson a2 is title "The Two Greetings" (fTC2 isfie, 32ict its সম্ভানটিকে দুই ভাবে তিনি সম্ভাষণ করিয়াছেন। প্রথমত, তাহার নিজের সন্তান বলিয়া; দ্বিতীয়ত, তাহার। আপনাকে তফাত করিয়া। এক, তাহার মর্ত জীবন ধরিয়া, আর-এক তাহার অস্তিত্ব ধরিয়া। একটিতে, তাহাকে আংশিক ভাবে দেখিয়া, আর-একটিতে তাহাকে সৰ্ব্বতোভাবে দেখিয়া। তাহার সন্তানের মধ্যে তিনি দুইটি ভাগ দেখিতে পাইয়াছেন; একটি ভাগকে তিনি স্নেহ করেন, আর-একটি ভাগকে তিনি ভক্তি করেন। প্ৰথম সম্ভাষণ মেহের সম্ভাষণ, দ্বিতীয় সম্ভাষণ ভক্তির। তাহার কবিতার এই উভয় ভাগেই কবি অনেকদূর পর্যন্ত দৃষ্টি প্রসারিত করিয়াছেন ; এক দিগন্ত হইতে আর-এক দিগন্তে দৃষ্টিপাত করিয়াছেন। প্ৰথম ভাগ। প্ৰথম, শিশু জন্মাইতেই তিনি ভাবিলেন, এ কোথা হইতে আসিল ? বৈদিক ঋষি-কবিরা মহা-অন্ধকারের রাজ্য হইতে দিগন্তপ্রসারিত সমুদ্রগর্ভ হইতে তরুণ সূর্যকে উঠিতে দেখিয়া যেমন সসম্রামে জিজ্ঞাসা করিতেন 'এ কোথা হইতে আসিল তেমনি সসম্রামে কবি জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কোথা হইতে আসিল ? তিনি বর্তমান দেশকালের বন্ধনসীমা অতিক্রম করিয়া কত দূরে কত উচ্চে অতীতের মহাগঙ্গোত্রীশিখরের দিকে ধাবমান হইলেন। কবির বিচরণের স্থান এমন আর কোথায় ? তিনি দেখিলেন, এই শিশুটি যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে সেই পৃথিবীরই সহোদর। মহাসৌরজগতের যমজ ভ্ৰাতা। তিনি তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, “বৎস আমার, মহাসমুদ্র হইতে, যেখানে যাহা-কিছু— ছিল'র মধ্যে যাহা-কিছু-হইবে (অর্থাৎ অতীতের মধ্যে ভবিষ্যৎ, অপরিস্ফুটিতার মধ্যে পরিস্ফুটন্তা) কোটি কোটি যুগ যুগান্তর ধরিয়া অগণ্য আবর্তমান জ্যোতিঃপুঞ্জের মহামরুর মধ্যে ঘূর্ণ্যমান হইতেছিল, তুমি সেইখান হইতে আসিতেছ। সেইখান হইতেই সূৰ্য আসিয়াছে, পৃথিবী ও চন্দ্র